শিরোনাম
রবিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

গান্ধী ও বার্নার্ড শ নতুন সভ্যতার ধারক

মতিয়ার রহমান পাটোয়ারী

গান্ধী ও বার্নার্ড শ নতুন সভ্যতার ধারক

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯৩১ সালে গোলটেবিল বৈঠক ডাকলে তাতে অংশ নিতে মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী লন্ডন যান। ওই গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় গোলটেবিল ঘোষণা করলে সাপ্রু, মুকুন্দ রামরাও জয়কর ও শ্রীনিবাস শাস্ত্রী মীমাংসার জন্য অনুরোধ করলে গান্ধীজি ও ভাইসরয় আরউনের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে মহাত্মা গান্ধী ছিলেন একক প্রতিনিধি। তাঁর সঙ্গে নারী প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন সরোজিনী নাইডু।

লন্ডনে গান্ধীজির থাকার ব্যবস্থা হয় ইস্টএন্ডের গরিব পাড়ায় অবস্থিত ‘কিংসলে হল’ নামক সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানে। জায়গাটা কতকটা আশ্রম কতকটা ক্লাব। যুদ্ধে নিহত কিংসলে লেস্টারের বোন মুরিয়েল পরিচালক। কিংসলে হলের তিন তলায় গান্ধীজির থাকার ব্যবস্থা হয়। গান্ধীজি তাঁর সেক্রেটারি মীরাবেনকে নির্দেশ দেন তার খোরাকের জন্য দেড় শিলিং বা এক টাকার বেশি যেন খরচ না হয়। লন্ডনে গিয়েও তিনি বেশভূষা পাল্টান না। সেখানে দীন-দুঃখীদের সঙ্গে মেলামেশা এবং অন্যদিকে ধার্মিক, বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী-গুণী ও রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ গান্ধী এখন লন্ডনে- পত্রপত্রিকায় এ খবর দেখে নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শর স্ত্রী শার্লোটের আগ্রহ হলো শর সঙ্গে গান্ধীর সাক্ষাতের। আগ্রহের কথাটি তিনি স্বামীকে জানালেন। বার্নার্ড শ তাতে রাজি হন না। তাঁর মতে ভারতীয়রা সবাই ফান্ডামেন্টালিস্ট (মৌলবাদী)। তাদের নেতা গান্ধীও তাই। তাঁর সঙ্গে তিনি দেখা করবেন না। বার্নার্ড শ তখন জগদ্বিখ্যাত নাট্যকার। তাঁর অপরিমেয় ঔদ্ধত্য। ১৯২৫ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করলে তিনি পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ডিনামাইট তৈরির জন্য আলফ্রেড নোবেলকে ক্ষমা করতে পারি কিন্তু নোবেল পুরস্কার প্রবর্তককে ক্ষমা করতে পারি না। কারণ মানুষরূপী একমাত্র শয়তানই এমন পুরস্কার প্রবর্তন করতে পারে।’ পরে স্ত্রী শার্লোটের পীড়াপীড়িতে পুরস্কার গ্রহণে রাজি হন। তবে তিনি আর্থিক পুরস্কার গ্রহণ করেননি। তখন তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘ম্যান অ্যান্ড দ্য সুপারম্যান’, আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’ সাড়া বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ‘ম্যান অ্যান্ড দ্য সুপারম্যান’-এ ঈশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’-এ বলতে চেয়েছেন যুদ্ধ মানুষের প্রয়োজনে নয়, নিছক তাগিদে (তখন এ নাটকটি অনেকের অনুরোধে তিনি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্যসূচিভুক্তির সম্মতি অনুমতি দিয়েছেন)।

গান্ধী কিংসলে হলের সামনে এক কাপড় পরে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। তাঁর হাত ছিল চরকায়। জর্জ বার্নার্ড শ ও শার্লোট তাঁর সামনে গিয়ে বসেন। শ বসে কোনো কথা বললেন না। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন গান্ধীর দিকে। শ একসময় মুখ খুললেন। বললেন, আচ্ছা, আপনি কি এ লন্ডন শহরে কাউকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এ শহরের সবচেয়ে দামি নাচঘর কোনটি? এবার বার্নার্ড শর দিকে মনোনিবেশ করলেন গান্ধী।

বার্নার্ড শ আবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন এখানকার সবচেয়ে দামি দর্জির দোকান কোনটি?

গান্ধীজি আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, হ্যাঁ।

মুচকি হেসে শ বললেন, যাকে আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমিই সেই লোক, জর্জ বার্নার্ড শ। বসে আছি আপনার সামনে। (গান্ধীর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সময় বার্নার্ড শ লন্ডন শহরে ভবঘুরে হয়ে দিনাতিপাত করতেন। একটি সাপ্তাহিক সংগীত পত্রিকায় সমালোচনা লিখে সম্মানী পেতেন ২০ সিলিং। এটাই ছিল তাঁর আয়)। গান্ধী তখন বললেন, তরুণ বয়সে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে এসে ইউরোপিয়ান সভ্যতা জানতে, বুঝতে ও উপলব্ধি করতে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, বিভিন্ন পরিবেশে মিশেছি। এ জন্য এ অপরিচিত শহরে কারও কারও সহযোগিতা নিতে হয়েছে। গান্ধীজির কথায় সমর্থন জানিয়ে বার্নার্ড শ তাঁর দিকে হাত বাড়ালেন করমর্দনের জন্য। বললেন, আমরা উভয়েই নতুন সভ্যতার ধারক ও বাহক।

কিংসলে হলে আনন্দ-বিনোদনের সময় গান্ধীজির ডাক পড়ত। ওখানকার প্রায় সব লোকই নৃত্যস্থলে উপস্থিত থাকত। একদিন শ্রমিক নর-নারীর পক্ষ থেকে একজন বললেন, মি. গান্ধী! আপনি আমাদের সঙ্গে নাচবেন না? তাদের অনুরোধে গান্ধী বললেন, নিশ্চয়। তবে আমার হাতের ছড়ি হবে আমার সঙ্গিনী।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিড়লা হাউসে সান্ধ্য প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে তাঁকে নাথুরাম নামে এক ব্যক্তি গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এ খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। জর্জ বার্নার্ড শর কানে এ খবর গেলে প্রথমে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এরপর বিড়বিড় করে বলেন, তাঁর মতো একজন লোককে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হলো! আততায়ীটা কে? তিনি রাতে আর ঘুমাতে পারেন না। ছটফট করে কাটান। একবার সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে একটি পত্র লিখবেন। যে ব্যক্তি গান্ধীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে তাকে যেন মৃতুদন্ড দেওয়া হয়।

ব্রিটিশ আইনে মৃতুদন্ড দেওয়ার কোনো বিধান নেই। এমনকি জর্জ বার্নার্ড শ সব সময় মৃতুদন্ড দেওয়ার বিরোধী। সেই বার্নার্ড শ গান্ধীর ঘাতককে মৃতুদন্ড দিতে বললেন। তিনি পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন কিনা এ বিষয়টি জানা যায়নি। আত্মজীবনী গ্রন্থে শুধু চিঠি লেখার ইচ্ছার উল্লেখ আছে। এ ব্যাপারে তিনি কোনো বিবৃতি দিয়েছিলেন কিনা তাও কোনো গবেষণাপত্রে দেখা যায়নি। (যেমন গান্ধীজিকে হত্যার পর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন শোক জ্ঞাপন করে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে তারা বিশ্বাস করতে চাইবে না রক্তে-মাংসে গড়া এমন একজন মানুষ পৃথিবীতে পদচারণ করেছিলেন)। গান্ধীর অস্বাভাবিক মৃত্যু জর্জ বার্নার্ড শর মতো একজন মানবতাবাদী ও শিল্পীমনে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছিল তা পরিষ্কার।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর