যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালে যে বিষয়টি সবার নজর কাড়ে তা হচ্ছে এ দেশের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এককথায় বিস্ময়কর। নদীমাতৃক নয় এ দেশ। তাই উন্নত নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সড়ক যোগাযোগের তুলনায় রেলপথ পিছিয়ে আছে। তবে নিউইয়র্কসহ কয়েকটি বড় সিটিতে সাবওয়ে বা মেট্রোরেল জনপ্রিয়। সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর সুফল পাচ্ছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় ‘এ নেশন অন হুইলস’। সবাই ছুটছে। নেই তিন চাকার ধীরগতির কোনো যান। দুই চাকার মোটরসাইকেল কদাচিৎ চোখে পড়ে। শখ করে কেউ হয়তো মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। হাইওয়েতে এত যে যানবাহন কিন্তু যানজটে স্থবির হয়ে পড়ছে না। সবাই শৃঙ্খলা মেনে চলছে।
বিশাল দেশ যুক্তরাষ্ট্র। মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত। এর একটি হচ্ছে জর্জিয়া। রাজ্যের রাজধানী আটলান্টায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞ বিশ্ব অলিম্পিকের আসর বসেছিল ১৯৯৬ সালে। এবারকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জিয়া বারবার আলোচনায় এসেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি আটলান্টা ঘুরতে যাই। উদ্দেশ্য, বেড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশি গ্রোসারি স্টোর থেকে কেনাকাটা করা। এক ঢিলে দুই পাখি মারা। মিসিসিপির স্টার্কভিল থেকে সড়কপথে আটলান্টার দূরত্ব পাক্কা ৩০০ মাইল। চালকের আসনে এবারও আমার জামাতা ড. তন্ময় ভৌমিক। লং ড্রাইভিং তার শখ। দিনের দিন ফিরে আসার পরিকল্পনা। সকাল ৭টায় যাত্রা। দুপুর ১টা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই আটলান্টায়। পথে দুবার স্বল্প সময়ের যাত্রাবিরতি। যাত্রাপথে আলাবামা অঙ্গরাজ্যের কিছু অংশ মাড়াতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর আটলান্টা। আয়তনে বড়। আটলান্টা সিটি ঘিরে বৃত্তাকার হাইওয়ে। কাজ সেরে ফিরতি যাত্রা করতে বিকাল ৫টা গড়িয়ে যায়। স্টার্কভিলে যখন ফিরে আসি তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে ১০টা। যাওয়া-আসা মিলিয়ে পাক্কা ৬০০ মাইল। প্রায় হাজার কিলোমিটার। এত দীর্ঘ ভ্রমণের পরও কোনো ক্লান্তি নেই।
দেশব্যাপী মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত এ দেশের সড়ক নেটওয়ার্ক। হাইওয়ে ধরে পিঁপড়ার সারির মতো বিরামহীন ছুটে চলেছে যানবাহন। কোথাও ক্রসিংয়ে আটকে থাকার বিড়ম্বনা নেই। নির্দিষ্ট গতিসীমা মেনে যে যার লেন ধরে এগিয়ে চলেছে। কেউ হর্ন বাজাচ্ছে না। কোনো রেষারেষি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় আছে ইন্টারস্টেট হাইওয়ে যা ‘আই’ দিয়ে চিহ্নিত। দীর্ঘতম হচ্ছে আই ৯০। আছে ইউএস হাইওয়ে সিস্টেম যা ‘ইউএস’ দিয়ে চিহ্নিত। দীর্ঘতম হচ্ছে ইউএস ২০। আর আছে স্টেট হাইওয়ে যা স্টেটের জন্য নির্দিষ্ট দুটি অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত। কেউ আগে যেতে চাইলে একে অন্যকে সুযোগ করে দিচ্ছে। নির্দিষ্ট ‘এক্সিট’ নিয়ে এক হাইওয়ে থেকে অন্য হাইওয়েতে সহজেই যাওয়া যাচ্ছে। তবে ট্রাফিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে রক্ষা নেই। হাইওয়ে প্যাট্রল পুলিশ ওত পেতে আছে। শত অনুনয়-বিনয়েও কোনো কাজ হবে না। জরিমানার টিকিট হাতে ধরিয়ে দেবে। বারবার অপরাধ করলে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যাবে। এমনকি শেষমেশ ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। হাইওয়ের পাশে গ্যাস স্টেশন ২৪ ঘণ্টা খোলা। নিয়মিত দূরত্বে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বিশ্রামাগার।এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। সেবার আমরা ২০ বাংলাদেশি ব্যাংকার একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে মাস ছয়েক অবস্থান করি। এক উইকইন্ডে নিউইয়র্ক সিটির অদূরে জোন্স বিচে যাই। ফেরার পথে এক মজার ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক রাস্তার কোলঘেঁষে ধীর পায়ে সোজা হাঁটছেন। একজন পুলিশ অফিসার তার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। হাইওয়ে প্যাট্রল পুলিশের সন্দেহ হয়েছে ভদ্রলোক মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আসলেই তিনি মাদকাসক্ত কি না তার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন কি না তা দেখা হচ্ছে। মাদকাসক্ত প্রমাণিত হলে মামলা হবে। অন্য এক দিনের ঘটনা। ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্ক ফেরার পথে উল্কার বেগে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ির বহর। হঠাৎ থেমে গেল আমাদের গাড়ি। পেছনে হাইওয়ে পুলিশের কার। সাইরেন বাজিয়ে থামার সংকেত দিচ্ছে। রসিদ বই হাতে ধীরে-সুস্থে এগিয়ে এলেন স্মার্ট পুলিশ অফিসার। গাড়ির কাগজপত্র চেয়ে নিলেন। ওভার স্পিডিংয়ের দায়ে জরিমানা হয়ে গেল। মার্কিন মুলুকে ট্রাফিক আইনের কতটা কড়াকড়ি প্রয়োগ তা বোঝাতেই এ দুটি ঘটনার অবতারণা।
যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোল-ডিজেলের দাম তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য, পরিবহন ব্যয় সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা। প্রতি গ্যালন পেট্রোলের দাম কমবেশি সোয়া ২ ডলার। লিটারপ্রতি যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫০ টাকা। তবে এলাকাভেদে দামের পার্থক্য আছে।
বাংলাদেশের সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোকে ক্রমান্ব^য়ে চার লেনে উন্নীতের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ইতিমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত মহাসড়ক আট লেনের। ঢাকা-সিলেট ও যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক উন্নয়নের কাজ সমাপ্তির পথে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের নান্দনিক রূপ বিমোহিত করে ভ্রমণকারীদের। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এলাকা এখনই ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিজয় দিবসে রাজধানীর আগারগাঁও-উত্তরা রুটে চলবে মেট্রোরেল। দ্রুত বদলে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ।
লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।