হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মাবলম্বীর কাছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নৌকা একটি পবিত্র বাহন। এ চার ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থসমূহে নৌকাকে একটি জীবন রক্ষাকারী বা উদ্ধারকারী নৌযান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পবিত্র আল কোরআনের সুরা আল মুমিনের ২৭ নম্বর আয়াতে হজরত নুহ (আ.)-এর আমলে সৃষ্ট মহাপ্লাবন এবং একটি নৌকার মাধ্যমে নুহ (আ.) তাঁর অনুসারী ও পৃথিবীর সকল প্রকার জীবিত প্রাণিকুলের একটি করে জোড়াকে মহাপ্লাবনে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার বর্ণনা রয়েছে। একই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে খ্রিস্টানদের বুক অব জেনেসিসের ৬ থেকে ৯ নম্বর অধ্যায়ে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৬ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘তুমি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপিও হও অথচ তোমার কাছে যদি পবিত্র জ্ঞান নামক নৌকাটি থাকে তবে তুমি দুঃখের সাগরও পাড়ি দিতে পারবে।’ বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র আলগাড্ডুপামা সুত্তামের ২২ নম্বর অধ্যায়ে নদীর এক কিনারকে পৃথিবীকে দুঃখ ও কষ্টময় এবং অন্য কিনারকে (পরকাল) সুখের ঠিকানা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর সেই নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য খড়কুটো, বাঁশ, কাঠ প্রভৃতি দিয়ে ছোট নৌকা বা রাষ্ট্র তৈরির কথা উপস্থাপিত হয়েছে।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে নৌকা একটি সংগ্রামের প্রতীক। ১৯৪৭ সালের ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ দেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ উপলব্ধি করে যে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে থাকার আরেক নাম ব্রিটিশের বদলে আরও নিকৃষ্ট ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন মেনে নেওয়া, এ অপশাসন থেকে মুক্তি তথা অর্থবহ স্বাধীনতার তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকায় ‘রোজ গার্ডেন’ নামে পরিচিত কে এম বশির আহাম্মেদের বাড়িতে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, যা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। দ্রুতই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সংগঠনের প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন। আর তৎকালীন আমজনতার নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আস্থার বাহন ‘নৌকা’ নির্ধারিত হয় দলীয় প্রতীক হিসেবে। এ নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়লাভ করে। আর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নৌকা ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় পায়। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রেক্ষাপটেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ও ডাকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নৌকা ছিল পশ্চিমা সৈন্যদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল, অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন এবং রসদ পরিবহনের অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। নৌকায় সাধারণ মাঝি বা জেলের ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধা বিশেষত গেরিলারা ভয়ংকর আঘাত হানে পাকিস্তানিদের ওপর। খাল ও নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজ ধ্বংস করে পশ্চিমাদের চলাচল এমনকি পিছু হটার পথও বন্ধ করে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। চূড়ান্ত আক্রমণের সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সব যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে দ্রুত ঢাকার অদূরে পৌঁছে দিতে বেশ কিছু সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ গ্রামবাসীর নৌকা ব্যবহৃত হয়। ১৬ ডিসেম্বর, ’৭১-এ দেশ স্বাধীনের ঠিক তিন মাস পর ১৭ মার্চ, ’৭২-এ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান মিত্র ইন্দিরা গান্ধী সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মবার্ষিকী। গুরুত্বপূর্ণ এ দিনে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী তৎকালীন রমনার রেসকোর্স ময়দানে ময়ূরপঙ্খী নৌকার আদলে তৈরি মঞ্চে আসন গ্রহণ এবং বক্তৃতা করেন। তাঁদের স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা গেয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা দেওয়া কালজয়ী নজরুলগীতি, ‘দুলিতেছে তরী (নৌকা), ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী (নৌকা) পার\’
নজরুলের অপূর্ব সৃষ্টি এ গানের কথা আজ বারবার কেন মনে পড়ছে, তার ইঙ্গিত লেখার শেষে দেওয়ার চেষ্টা করব, তবে তার আগে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা ও সামাজিক জীবনে নৌকার প্রভাবের দিকে নজর দেওয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের নৌকাকেন্দ্রিক রচিত পুস্তকসম্ভারে রয়েছে ঘাটের কথা, সোনারতরী, নদী, খেয়া ও নৌকাডুবি। নজরুল, মধুসূদন, শরৎচন্দ্র, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন নানাভাবে নৌকাকে প্রতিপাদ্য করেছেন তাদের সাহিত্যকর্মে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন রচিত নক্সী-কাঁথার মাঠ, বালুচর, সোজন বাদিয়ার ঘাট, পদ্মা নদীর দেশে, বেদের মেয়ে, পদ্মাপার, মধুমালা, পল্লী বধূ, রঙিলা নায়ের (নৌকার) মাঝি, গাঙ্গের পাড় প্রভৃতি গ্রন্থের পরতে পরতে রয়েছে নৌকার কথা। নৌকা নিয়ে রচিত গানের সংখ্যা নিয়ে গবেষণা হয়েছে কি না জানি না। তবে এ সংখ্যা হাজার ছাড়াবে বলে আমার ধারণা। নৌকা ভ্রমণ নিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে রচনা শেখেনি বা লেখেনি কিংবা নৌকার ছবি আঁকেনি এমন শিক্ষার্থী অন্তত বাংলাদেশে নেই। বর্ষায় পানিতে কাগজের আর কাদা দিয়ে নৌকা বানানোর স্মৃতি অমলিন থাকে বহুদিন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বউ, হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন ও শ্যামল ছাড়া প্রভৃতি উপন্যাসে নৌকা জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। চলচ্চিত্রের পর্দায় ছোটগল্প, কবিতা, ছড়া, কারুশিল্প কোথায় নেই নৌকা। বাউল ও আধ্যাত্মিক জগতের মানুষের কাছে জীবনটাই তো একটা নৌকা। মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, কোন মিস্ত্রি নাও বানাইল, দে দে পাল তুলে দে, পাড়ে লয়ে যাও আমায়, প্রভৃতি গানে সাধককুল জীবন নৌকার হিসাব খোঁজেন। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে নৌকায় মাইজভান্ডার ও আহালা দরবারের ওরসে যেতাম, যাওয়া ও আসার সময় একদিকে নৌকায় থাকা গায়কদের (কাওয়াল) ঢোল তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশি ও মন্দিরার ছন্দগান ও জিকিরের সুর আর অন্যদিকে ভক্তকুলের মাথাভর্তি বাবরি চুলের ঢেউ একাকার হতো কর্ণফুলীর ঢেউয়ের সঙ্গে, যার স্মৃতি আজও মনে পড়ে।
মনে পড়ে নৌকাবাইচের কথা। নদীর পাড়ে হাজারের মানুষের ভিড়। রীতিমতো মেলা বসে যেত নৌকাবাইচ দেখতে। হরেকরকম নৌকা নিয়ে টানটান উত্তেজনায় চলত নৌকাবাইচ। কি সুঠাম দেহ ছিল সেই মাঝিমাল্লাদের। বিশ্বের বহু দেশে নানা আকৃতির নৌকা নিয়ে বহু বিনোদন, প্রতিযোগিতা প্রদর্শনী হয়। সৌভাগ্য হয়েছে তার কিছু কিছু দেখার, এসব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য থাকে নাগরিক সমাজ বিশেষত তরুণ ও যুবকদের সুস্থ বিনোদনের খোরাক এবং খেলা ও প্রতিযোগিতার ছলে সুঠাম দেহ তৈরিতে সহায়তা করা। পাহাড়ি খরস্রোত নদীতে র্যাফটিং বা বিশেষ ধরনের নৌকা চালানো সামরিক প্রশিক্ষণের একটি অংশ।
আজ এই ভেবে অবাক লাগে যে, সেই নৌকা আবার আলোচনার শিরোনাম হলো, তবে নেতিবাচকভাবে এবং ইংরেজিতে বোট (ইড়ধঃ) নামে। ঢাকার অদূরে বোট ক্লাবে নায়িকা পরীমণির অঘটনের কথা আজ সবার মুখে মুখে। বিরুলিয়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে বর্ষায় তুরাগ নদের সৌন্দর্য ও নদের হাওয়ার পরশ উপভোগ করেছি বহুবার। ব্রিজে দাঁড়িয়ে বোট ক্লাবের বিশাল ও অত্যাধুনিক ইমারত দেখা যায়। কিন্তু বোট ক্লাবের কোনো নৌকা কোনো দিন নদে ভাসতে দেখিনি। অথচ বিদেশে ছুটির দিনে রংবেরঙের পালতোলা নৌকায় রঙিন হয়ে উঠত নদীর বুক। সে কি অপরূপ দৃশ্য- দুজনের জন্য নির্মিত বিশেষ নৌকায় দম্পতি কিংবা প্রেমিক- প্রেমিকারা যেন প্রকৃতই প্রেমনদীতে নাও ভাসাত। কৌত‚হলবশত নিশ্চিত হতে ফোন করেছিলাম ঢাকা বোট ক্লাবে ১৬ জুুন। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হলো সেখানে নৌকা আছে, তবে এখনো চালু হয়নি। এরই মাঝে খবর বেরোলো বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদে ওয়াটার বাস নামক কৃত্রিম নৌকা চালানোর ব্যর্থ চেষ্টায় সরকারের ক্ষতি কয়েক শ কোটি টাকা।
এমন দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা খুব মনে পড়ে। মূলত তিনিই ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ নামক নৌকার মাঝি। সঙ্গে পেয়েছিলেন চার জাতীয় নেতার মতো দক্ষ চার মাল্লা। সেই নৌকাকে গতিহীন আর গন্তব্যহীন করতে কি নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করল ঘাতকের দল। নৌকাকে বাঁচাতে সেই ঘাতকের অনুসারীরা কোথায় কোথায় আছে, তা খুঁজতে হবে। নৌকা প্রতীক নিয়ে একই আসনে নির্বাচনের জন্য অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীর হাজার হাজার পোস্টারে রাস্তাঘাটের সৌন্দর্যহানি কোনো শুভলক্ষণ নয়। নৌকা চালানো তথা নৌকাকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। সবাই যদি নিজেকে মাঝিতুল্য মনে করে তবে মাল্লা আর যাত্রী সংকটে পড়বে নৌকা। একটি নির্বাচনে সর্বমোট ২০%-২৫% ভোট কি নৌকায় মাল্লা আর যাত্রীর সংকটই প্রমাণ করে না?
সব শেষে বলি, চাই তরুণ-যুবকের উচ্ছ্বাসে ভরা নৌকাবাইচ-কেন্দ্রিক সংগঠন। বোট ক্লাবে আর যেন কোনো জিন-পরীর নজর না পড়ে। জীবনের শেষ দিনগুলোয় রবীন্দ্রনাথের কাগজের নৌকা কবিতায় লেখা পঙ্ক্তিমালার মতো কাউকে যেন বলতে না হয়-
‘কোন পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধরে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে,
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে।’
পাদটীকা : দেশ যখন উন্নতির মহাসড়কে, রিজার্ভ অর্থ যখন উপচে পড়ছে ঠিক তখনই মৃত্যুকে হাতে নিয়ে এ দেশেরই শত শত যুবকের তিউনিসিয়া বা লিবিয়া হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় চেপে ইউরোপযাত্রা মোটেই মানানসই নয়। নৌকাকে যারা ভালোবাসেন তাদের উচিত এ মরণযাত্রা রোধ করা।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।