শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

চৈত্রের ওয়াজ পৌষে নয়

মহিউদ্দিন খান মোহন

চৈত্রের ওয়াজ পৌষে নয়

গল্পটি বেশ পুরনো। অনেকেই জানেন। তবু আরেকবার বলি। পৌষের রাতে এক গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হচ্ছিল। মৌলভি সাহেব ওয়াজে বললেন, ‘পরস্ত্রীর পরনের কাপড় দিয়ে তৈরি কাঁথা গায়ে দেওয়া পুরুষের জন্য নাজায়েজ’। ওয়াজ শেষ হলো গভীর রাতে। অত রাতে মৌলভি সাহেব তার বাড়িতে যেতে পারবেন না। তাই সে গ্রামেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু গোল বাধল শোয়ার সময়। ওয়াজের আয়োজকরা বললেন, ‘হুজুর, আমাদের গ্রামের মানুষ খুব গরিব। তাদের কারোরই লেপ নাই। আর মেয়েদের কাপড়ের তৈরি কাঁথাও তো আপনি গায়ে দেবেন না। এখন তো ভারি বিপদ হলো।’ মৌলভি সাহেব বললেন, ‘না না, সমস্যা নাই। আমি আমার চাদর গায়ে দিয়েই রাত পার করে দিতে পারব।’ কিন্তু গ্রামের টিনের ঘরে প্রচন্ড শীতে হুজুর সারা রাত কাঁপলেন, তার জ্বর এসে গেল। সকালে উঠেই তিনি কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলেন তার ওস্তাদের কাছে। বললেন, ‘হুজুর, এ আপনি আমাকে কী ওয়াজ শিখাইলেন। আমি যে এখন জ্বরে মরি।’ সব শুনে ওস্তাদ হুজুর বললেন, ‘আরে বোকা! এটা তো চৈত্রের ওয়াজ, যখন কাঁথার দরকার হয় না। এ ওয়াজ তুই পৌষে করতে গেলি ক্যান?’ গল্পটির একটি মোজেজা আছে। তা হলো, সব কথা সব সময় বলতে নেই। বললে হিতে বিপরীত হতে পারে।

গল্পটি বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানা কি না আমার জানা নেই। জানা থাকলে ২৬ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে চৈত্রের ওয়াজ পৌষে করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তেন না। জাফরুল্লাহ সাহেব হয়তো ভেবেছিলেন যেহেতু বিএনপির সিনিয়র নেতারা তাকে সমীহ করেন, সরকারের সমালেচনা করে তাঁর বলা কথাবার্তা সমর্থন করেন তাই তাঁর কথায় কেউ অসন্তুষ্ট হলেও মুখের ওপর কেউ কিছু বলবে না। তাই তিনি তাঁর বিবেচনায় বিএনপির জন্য যা ভালো মনে করেছেন অকপটে তা-ই বলে দিয়েছেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও এক ছাত্রদল কর্মী উদ্ধত ভঙ্গিতে তাঁকে শুধু কথা বলতেই বাধা দেয়নি, ভবিষ্যতে তাদের নেতা সম্পর্কে কোনো কথা বললে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তার জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীই দায়ী থাকবেন বলে শাসিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সরাসরি হুমকির নামান্তর। এ ধরনের হুমকির বিরুদ্ধে ইচ্ছা করলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে সংগত কারণেই হয়তো তিনি তা নেবেন না।

অনুষ্ঠানটি ছিল ‘এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই)’ নামে একটি সংগঠনের গোলটেবিল আলোচনা। সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন সংগঠনটির প্রধান। করোনাকালীন বাজেট ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ওই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেখানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে কিছু উক্তি করেই গোল বাধিয়ে ফেলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বিএনপির ওহি লন্ডন থেকেই বেশি আসে। এ সরকারের পতন ঘটাতে হলে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটাতে হবে বিএনপির নিজের ঘরে। আমি বারবার বলেছি, খালেদা জিয়ার যদি মুক্তি চাও তারেক তুমি দুই বছর চুপচাপ বসে থাক। পার তো বিলেতে লেখাপড়ায় যুক্ত হয়ে যাও। সেখানে বহুভাবে লেখাপড়া হয়।’ এ সময় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে বচসায় লিপ্ত হয় এবং উপরোক্ত হুমকি দেয়। ঘটনাটি যে নিন্দনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ ছুড়ে ফেলে উচ্চশিক্ষা বাদ দিয়ে লন্ডন থেকে ছুটে এসে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন। ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রƒষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আনুকূল্যে তিনি দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। বাংলাদেশে একটি সমন্বিত ওষুধনীতি প্রণয়নে রয়েছে তাঁর বিরাট ভূমিকা। বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে তাঁর রয়েছে বিশাল অবদান। স্পষ্টবাদী মানুষ তিনি। যাকে সত্য আর যৌক্তিক মনে করেন নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন। সেজন্য সচেতন মানুষের কাছে তিনি যেমন সমাদৃত তেমনি তাঁর কথায় যাদের স্বার্থহানি ঘটে বা মনমতো হয় না তাদের তিনি চক্ষুশূলও। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সরকারের সমালোচনা করে তাঁর কিছু কথাবার্তা এবং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিপরীতে একটি বৃহত্তর জোট গঠনে ভূমিকার জন্য তিনি এ পরিচিতি পেয়েছেন। তবে বিএনপি তাঁকে আদৌ নিজেদের থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে করে কি না তা নিয়ে আমার অন্তত ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। কেননা বিএনপির বর্তমান রাজনীতি হচ্ছে নেতিবাচক। তারা মেধাবী, দক্ষ ও কর্মস্পৃহ কোনো ব্যক্তিকে ধরে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও সেখানে হয় বলে মনে হয় না। বিএনপি এখন আর তার ধারণক্ষমতা বাড়ানোর ভাবনা-চিন্তায় নেই। কোনো পরিকল্পনায়ও নেই। আছে অপছন্দের ব্যক্তিকে কীভাবে ছেঁটে ফেলা যায় সে চেষ্টায়। ফলে দেশের শিক্ষিত, মননশীল ও মেধাবীরা এখন আর এ দলের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে না। পরিবর্তে সেখানে সমাবেশ ঘটেছে কিছু উদ্ধত, বেপরোয়া ও অসংযমী যুবকের, যারা শুধু ‘এক নাম জপ’ করতে অভ্যস্ত; এর বাইরে তাদের কোনো রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নেই।

কেউ যদি জিয়াউর রহমানের বিএনপির সঙ্গে আজকের বিএনপিকে মেলাত যান তাকে হতাশ হতে হবে নিঃসন্দেহে। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যাঁরা রাজনীতি করেছেন তাঁদের মুখে শুনেছি তিনি সব সময় বিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ নিতেন। তাঁর উপদেষ্টার তালিকা আর এখন বিএনপির উপদেষ্টা তালিকার দিকে তাকালে চরম আশাবাদী ব্যক্তিও হতাশ না হয়ে পারবেন না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির একজন শুভাকাক্সক্ষী সন্দেহ নেই। সময়ে সময়ে তিনি বিএনপিকে তথা এর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা, ২০১৬ সালের আগস্টে তিনি সংবাদপত্রে দেওয়া এক খোলা চিঠিতে খালেদা জিয়াকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই খোলা চিঠিতে তিনি ১৫ আগস্ট ঘটা করে সেবার জন্মদিন পালন না করায় অভিনন্দন জানিয়ে বিএনপি ও বেগম জিয়ার নানা ভুলত্রুটির কথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে বিএনপিকে পুনরায় সরকারে ফিরে আসতে হলে কী করা দরকার আর কী পরিহার করা উচিত তা-ও উল্লেখ করেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, ডা. জাফরুল্লাহর সেসব পরামর্শ বিএনপি বা খালেদা জিয়া ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েছেন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মনে আছে, ওই সময় বিষয়টি নিয়ে একটি টিভি চ্যানেলের আলোচনায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে উপস্থাপক প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি কি মনে করেন বিএনপি আপনার পরামর্শ গ্রহণ করবে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি যা ভালো মনে করেছি বলেছি। গ্রহণ করা না করাটা তাদের ব্যাপার। এ সময় একজন আলোচক মন্তব্য করেছিলেন, আমার তো মনে হয় এই খোলা চিঠির কারণে আপনার জন্য বিএনপির দরজা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মাঝেমধ্যে চায়ের দাওয়াত পেতেন তা-ও হয়তো আর পাবেন না। হেসে উঠেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বলেছিলেন, তাহলে তো আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হয়। না, তার পরও বিএনপির দরজা তাঁর জন্য বন্ধ হয়নি। খোলা চিঠি নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া বেগম জিয়া প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেননি। ভিতরে কিছু বলেছিলেন কি না আমরা জানি না। তবে এটা ঠিক, একই কাজের ফল সব সময় এক রকম হয় না। পিতা-মাতা সমালোচনা বা পরামর্শকে যে মানসিকতায় গ্রহণ করেন, সন্তানরা সে একই মানসিকতা নিয়ে তা গ্রহণ করবে এমনটি আশা করা বোধকরি ঠিক নয়।

যাকে নিয়ে এত কথা মানে তারেক রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতাও ছিল। তিনি যখন দৈনিক দিনকালের নির্বাহী পরিচালক আমি তখন ওই পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। তারপর ২০০১-এর সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বনানীর ‘হাওয়া ভবন’ নামের একটি বাড়িতে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় স্থাপিত হলে বিএনপির নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রমে তিনিই আমাকে সম্পৃক্ত করেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে নিযুক্তি পাই। বলা যায়, সাত বছর তারেক রহমানকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। সে সময় তাকে আমার অত্যন্ত ধীর-স্থির ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্ন একজন উদীয়মান রাজনীতিকই মনে হয়েছে। রাজনীতির অনেক জটিল বিষয় নিয়ে তিনি আমার সঙ্গেও কথা বলেছেন। ওই সময় সেখানে সম্পৃক্ত ছিলেন দ্জুন ডাকসাইটে সাবেক আমলা। একজন ড. হাসান আহমেদ, অন্যজন মোফাজ্জল করিম। তাদের সঙ্গে তারেক রহমান পরামর্শ করতেন। কখনই তাকে নেতিবাচক অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে দেখিনি। একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা এবং দক্ষতা তার ছিল বলেই আমার তখন মনে হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি; যার পরিণতি সম্পর্কে আমি উদ্বিগ্নই ছিলাম। ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ বলে যে প্রবচনটি বাংলায় চালু আছে তারেক রহমানের ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় সেটাই প্রযোজ্য। দুর্নীতিবাজ, অপরিণামদর্শী এবং অপগন্ড টাইপের একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে যান তিনি। তাদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি তার স্বকীয়তা যেমন হারান তেমনি দূরে ঠেলে দেন প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীদের। মনে পড়ে, ২০০২ সালে ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চীন সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর মিডিয়া টিমের সদস্য হিসেবে আমিও ছিলাম সে সফরে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিনের সাক্ষাতের সময় তারেক রহমান সঙ্গে ছিলেন। তখন চীনের প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে বলেছিলেন, ‘তোমার হাতে দুটি পতাকা। একটি তোমার বাবার, একটি তোমার মার। এটা তোমার সম্পদ। ভবিষ্যতে এ সম্পদ কাজে লাগিও’। জিয়াং জেমিনের সে পরামর্শ তারেক রহমান কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছেন কি পারেননি সে বিতর্কে এখন না-ই বা গেলাম। তবে আজ যখন নানাজন নানা কথা বলে বড্ড কষ্ট হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!

আমার মতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হিসাবে ভুল করেছেন। তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল যাকে তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি জিয়াউর রহমান নন, নন খালেদা জিয়াও। জিয়াউর রহমান হলে হয়তো তাঁকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে আলাপ করতেন। খালেদা জিয়া হলেও দেখা হলে স্মিত হেসে হয়তো বলতেন, ডাক্তার সাহেব, পরামর্শগুলো কি সরাসরি আমাকে বলা যেত না? কিন্তু ওই যে কথায় আছে- ‘সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই’। জিয়া-খালেদা জিয়ার কাছ থেকে যা পাওয়া গেছে, তাদের উত্তরসূরির কাছে তা পাওয়া যাবে এমনটি আশা না করাই ভালো। তাঁর মনে রাখা দরকার ছিল, এখন সময় সমালোচনার নয়, তৈল মর্দনের। তিনি সেদিন প্রেস ক্লাবের আলোচনায় যে কথাগুলো বলেছেন তা না বলে তারেক রহমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলে তাঁকে নাতির বয়সী এক ছেলের ধমক খেতে হতো না। বরং তাঁর নামে জয়ধ্বনি উঠত। এজন্যই লোকে বলে, চৈত্রের ওয়াজ পৌষে না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর