বড় ফটকের শরীরের ডান দিকে ছোট্ট একটা ফটক। মাথা গলিয়ে যেই না ওই ফটক পার হলাম, অমনি রে রে রে করে উঠল তিন প্রহরী। আধুনিক বাংলায় এদের বলা হয় সিকিউরিটি। একজনের গড়ন অমিতাভ বচ্চনের মতো। গলার আওয়াজ অবশ্য হাঁপানি রোগীর। এই ব্যক্তির ইশারার অপেক্ষায় অন্য দুই সিকিউরিটি। যেভাবে দৃষ্টি হানছিল তাতে আশঙ্কা করি, লম্বুর নির্দেশ পাওয়ামাত্র এরা আমায় চ্যাংদোলা করে ফটকের বাইরের সড়কে সজোরে নিক্ষেপ করবে। লম্বুর ডানে দাঁড়ানো সিকিউরিটি বলে, ফারমিশন না নিয়া টুককুর করি গেইটের মধ্যে কল্লা ঢুকাই দিলেন! এরকুম কইল্লেন কিয়েল্লাই? এইখানে আপনের কী কাম?
‘জুবায়ের হাসান সাহেবের কাছে যাব’ বললে লম্বুর বাঁয়ের সিকিউরিটি বলে, কোন্ জুবায়ের? এই কোম্পানিতে তো তিন জুবায়ের। একজন কুমিল্লার, আরেকজন বরিশালের, আরেকজন কোন্ ডিস্টিকের মুহিবুল্লাহ ভাই? এতক্ষণে বোঝা গেল লম্বুর নাম মুহিবুল্লাহ! লোকটা তার জুনিয়র সহকর্মীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে, আনলিগাল এনটি মেরে দিয়েছেন আপনে। দেখতে তো শিক্ষিত সমাজ মনে হয়। ফারমিশন ছাড়া কারও বাড়িঘরে ঢুইকা পড়ন যে অভর্দতা, সেটা জানেন না?
ফটকে ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’ মর্মে ফলক ঝোলানো ছিল না। তা ছাড়া ছোট্ট ফটকটা ফাঁক করা অবস্থায় ছিল। সেজন্য ঢুকে গেছি। ঢুকেই অফিস ভবন চত্বরের টবে সাজানো ফুলবাগানের পাশে সিকিউরিটির ত্রিমূর্তির কবলে পড়েছি। ব্যাখ্যা শুনে লম্বু সিকিউরিটি সন্তুষ্ট হয়। তবু লিফটের দিকে যেতে দেয় না। কেননা তিন জুবায়েরের মধ্যে কোন্ জুবায়েরকে আমার চাই, তা বলতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় লম্বুর ডানের লোকটি বলে, নো ফ্রবলেম। আপনের নাম বলেন। এক এক কইরা সব জুবায়ের সাহেবরে জিগাইয়া আসি আপনেরে চিনেন কিনা।
আমি যে জুবায়েরের সাক্ষাৎপ্রার্থী তাঁর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে। তিনি এইচআরডির সিনিয়র একজিকিউটিভ। এই তথ্য দিলে অমিতাভ বচ্চন সাইজের সিকিউরিটি বলে, ফোরকান! তুই ইনারে পাগলা বাতেনের কাছে নিয়া যা। লম্বুর বাঁয়ের সিকিউরিটির নাম ফোরকান। সে বলে, ভাই মনে অয় শিউর পাগলা বাতেনই জুবায়ের। ওই পাগলার কাছে দুইন্নার শিক্ষিত সব পাগলারা আড্ডা দিতে আসে। গত মাসে ঝাঁকড়া চুল মাথা এক পাগলা কবিতা ফড়তে ফড়তে হঠাৎ হুঁশ হারাইয়া চিত্তইয়া যায়। ‘আরেকবার এক গাতক আইসা গান শুরু করলে আটতলার তুন বিগ বস্্ নাইমা আসেন আর চিল্লাইয়া কন, এটা অফিস? না কী চিড়িয়াখানা?
তেতলায় জুবায়ের হাসানের কামরাতেই আমায় পৌঁছে দেয় সিকিউরিটি ফোরকান। জুবায়েরের কাছে জানতে চাই, সিকিউরিটির লোকরা কেন তাঁকে ‘পাগলা বাতেন’ বলে। জুবায়ের জানান, অন্য কর্মচারীরাও তাঁকে ওই নামে চিহ্নিত করে চলেছে। কারণটা কী?
জুবায়ের হাসান বলেন, আন্তরিকতার খেসারত দেওয়ার অলিখিত ফরমান জারি করে রেখেছে প্রকৃতি। কার সাধ্য তা লঙ্ঘন করে! তাই দেখা যায়, যে অপরাধ করা হয়নি তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জুবায়ের বলেন, সাত বছর আগে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই নাটকের একটা চরিত্র ছিল ‘বাতেন পাগলা’। চরিত্রটি রূপায়ণ করেন জুবায়ের। তিনি বলেন, ‘আমি নাকি সার্থক অভিনয় করেছিলাম। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সেই সার্থকতার মজা।’
বাপসমান আংকল : আমাদের মহল্লার স্বনামখ্যাত শিক্ষক অদুদ আহমদের (মরহুম) দৌহিত্র ফরহাদ শাকিলের চাকরির ব্যবস্থা করতে জুবায়েরের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি জানান, তাঁদের এমডি খুলনা সফরে আছেন। ফিরে এলে এমডির সঙ্গে আমি যেন দেখা করি। সিনিয়র সাংবাদিকদের অনুরোধ এমডি কখনো নাকচ করেন না। নির্ধারিত দিনে এমডির সঙ্গে দেখা করতে যাই।
বসে আছি এমডি অফিসের অভ্যর্থনা কক্ষে। অদূরে ডেস্কে বসা এমডির পারসোনাল সেক্রেটারি (পিএস) সুবেশী প্রগলভ এক তরুণী। তাঁর হাতের বাঁয়ে স্তূপ করে রাখা গোটা দশেক ফাইল। দেখি, তিনি ল্যান্ডফোনে কথা বলে চলেছেন, ‘কসাই’ দেখনি। তাহলে তো কোনো মুভিই দেখনি। আলমগীর দুর্দান্ত অ্যাকটিং করেছে। জসীম? মাই গড! তাকে তো রিয়েল লাইফ বুচার মনে হচ্ছিল।
ফোনালাপ করতে করতে স্তূপকৃত ফাইলগুলো একটি একটি করে বাঁ থেকে বাঁয়ে নিচ্ছেন পিএস; আবার বাঁ থেকে নিচ্ছেন ডানে। বারংবার ফাইল স্থানান্তর চলছে আর আমার বিরক্তি টগবগ করছে। প্রায় পনেরো মিনিট অপেক্ষা করা হয়ে গেছে। আমি ছাড়া কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল না। তবু তিনি ইন্টারকমে বসকে বললেন না যে সাক্ষাৎপ্রার্থী এসেছে। এরই মধ্যে পিএস আরেক জায়গায় ফোনালাপে মেতে উঠলেন, ‘শর্ষে ইলিশ! একা একা খাবি তোরা? ... তন্দ্রা খালা ইউকে ফিরে গেল আমায় সেই খবরটাও দিলি না। ... য়্যাই ডোনা! তোর সঙ্গে আমার আড়ি। জনমের মতো আড়ি...।’
‘এই ফাজিল মেয়ে!’ রুষ্ট গলায় বলি, ‘কাম কাজ ফেলে রেখে খালি কসাই-ইলিশ-তন্দ্রা-ডোনা-আড়ি করে যাচ্ছ। তোমার সমস্যা কী। ভিজিটররা কী তোমার নানাবাড়ির প্রজা? রোজ হাশর পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রাখবে নাকি?’ পিএস থতমত খেয়ে বলেন, ধমক না মেরেও তো কথা বলা যায়। আমি তো বয়সে আপনার মেয়েসমান। বাপ হয়ে মেয়েকে অপমান করবেন!
মনে মনে বললাম, তুমি শুধু ফাজিলই নও, মহাধূর্তও বটে। মুখে বললাম, ‘বাপসমানকে যে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলে তার বেলায়?’ জবাবে সে দ্রুত এমডির কামরায় ঢোকে এবং দুই সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এসে বলে, ‘আসুন আংকল’। আমাকে সে এমডির মুখোমুখি করে।
প্রসঙ্গ- লাঞ্চটাইম : জিয়াউর রহমানের শাসনামলের গোড়ার দিকে চুপিচুপি ঢাকায় এসে ধানমন্ডিতে মেয়ের বাড়িতে ওঠেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী। বিষয়টি জেনে ফেলেছিলেন ‘পূর্বদেশ’-এর প্রাক্তন সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী। হায়দার ভাই কাজী রাশিদুল হক পাশা, মতিউর রহমান চৌধুরী (এখন মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক) আর আমাকে ‘তিন দামড়া’ খেতাব দিয়েছিলেন। আমরা তিন বন্ধু সেকালে জোটবদ্ধ হয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম এবং ফুরসত মতো জাতীয় প্রেস ক্লাবে এসে খাওয়াদাওয়া করতাম।
এক দুপুরে শুধু মতি আর আমি নগরীর নানা প্রান্তে চক্কর দিয়ে ক্লান্ত দেহে ক্লাবে ঢুকতেই হায়দার ভাই বলেন, পাকিস্তানি চৌধুরী বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার মতলবে ঢাকায় অবতরণ করেছে। তিনি মতিকে পরামর্শ দেন- “ব্যাডার একখান ইন্টারভিউ লইয়া ছাইপ্পা দাও না। তোমাদের ‘দেশবাংলা’র বাজার হটকেকের মতো হয়ে যাবে।” পরদিন বেলা ১১টার মধ্যে আমরা খুঁজে খুঁজে হামিদুলকন্যার বাড়িতে পৌঁছে যাই। হামিদুল হক চৌধুরী বই পড়ছিলেন। পঠন স্থগিত রেখে তিনি আমাদের সঙ্গে সংলাপে বসেন।
শোষিত-নিষ্পেষিত বাঙালির দুর্দশামোচনের উদ্দেশ্যে আপনি দৈনিক ‘অবজারভার’ পত্রিকা প্রকাশনায় নেমেছিলেন। বাঙালিরা আপনাকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত করেছিল। সেই আপনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি সেনার পক্ষ নিয়েছেন। এজন্য স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আপনার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে। এ এক বেদনাবহ ঘটনা। জীবনের বেশির ভাগ সময় বাঙালির স্বাধিকারের পক্ষে কাজ করার পর হঠাৎ উল্টো ভূমিকা নিলেন কেন?
প্রশ্ন করেছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী। জবাবে হামিদুল হক চৌধুরী স্মিত হেসে বলেন, লম্বা ব্যাখ্যা দিতে পারি। শুনে তুমি বিরক্ত হতে পার। তাই খুব সংক্ষেপে বলছি, আমার অঙ্ক ভুল ছিল। আমার অঙ্ক বলছিল শেখ মুজিব পারবে না। আমেরিকা তাঁকে চুরমার করে দেবে। কিন্তু মুজিব পেরে গেছেন।
জোহরের আজান শুনতে পেয়ে সংলাপ (কথা বলা হয় প্রায় দুই ঘণ্টা) শেষ করে প্রস্থানোদ্যত হই আমরা। দরজা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দেন হামিদুল হক চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, ‘আরে! তোমরা তো একটু চা-ও খেলে না।’ মতি বলেন, আপনি কি আমাদের চা অফার করেছিলেন? মতির প্রশ্নে বিব্রত হয়ে হামিদুলকন্যা বলেন, ‘প্লিজ! আসুন। আপনারা একটু চা খেয়ে যান।’
‘থ্যাংকস’! বলেন মতি, ‘এটা চা-খাওয়ার টাইম না। এটা লাঞ্চটাইম। আমরা ক্লাবে যাচ্ছি লাঞ্চ করার জন্য।’
হামিদুল হক চৌধুরীর ভুল অঙ্ক বর্ণনার স্মৃতি আমাকে নিয়ে যায় আমার স্কুলজীবনে। অঙ্কে আমার যে দক্ষতা তা গাধার দক্ষতারও নিচে। স্কুলে অঙ্ক ইংরেজি শেখাতেন দিনাজপুরের সন্তান খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর গোঁফ ছিল স্ট্যালিনের গোঁফের মতো। বিশালদেহী এই শিক্ষকের দৃষ্টি ছিল অন্তর্ভেদী। আমরা ভয় পেতাম। কিন্তু তিনি কাউকে চিমটিও কখনো কাটেননি। কণ্ঠস্বর ছিল গমগমে। ক্লাস এইটে অঙ্কে ২৭ পেয়েছিলাম। স্যার ক্লাসে আমায় বলেন, এদিকপানে আয় হনুমান। বলেই টেবিলে বেত্রাঘাত। মনে হচ্ছিল, পিটুনি দিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলবেন। কাছে গেলে স্যার পরম মমতায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘মন দিয়ে আঁকটা (অর্থাৎ অঙ্ক) শেখ বাবা। আঁকটা যদি ভালোভাবে না শিখলি তাহলে তো জীবনের বাঁকে বাঁকে পস্তাবি।’ শতভাগ খাঁটি কথা। কর্মফল ভোগ করে চলেছি।
ট্র্যাডিশন চলছে! : ৫ আগস্ট এই পাতায় গাধার গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু উপস্থাপন করায় গাধা গবেষণায় নেমে পড়েন আমাদের প্রিয় সৈয়দ আবদুস সালেক ভাই। ১৯৮৬ সালে রাজধানীর শাজাহানপুর এলাকায় তিনি আমার পড়শি ছিলেন। অনেক দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। সেদিন ফোনে তিনি বলেন, রবিঠাকুর গাধা বিষয়ে কিছু লিখলেন না। কী অদ্ভুত ব্যাপার। অথচ শেকসপিয়ার গাধা চর্চা করেছেন। ‘আ মিডসামার নাইটস ড্রিম’-এ শেকসপিয়ার দেখিয়েছেন, মানুষের নিতম্ব জাদুর ছোঁয়ায় গাধা হয়ে গেছে এবং সেই গাধাটি রানি টিটানিয়ার প্রেমে পড়েছে। গাঁজাখুরি ব্যাপার! তবে স্বীকার করছি কেচ্ছাটা উপভোগ্য।
মন্ত্রী গাধার মতো উপভোগ্য? সালেক ভাই বলেন, সেটা আবার কী! তাঁকে জানাই, ধোপা রাজাকে বারণ করে আজ শিকারে যাবেন না হুজুর। ঝড়ের কবলে পড়বেন। হুঁশিয়ারি পরোয়া না করে রাজা শিকারে যান এবং ঝড়কবলিত হয়ে প্রাসাদে ফেরেন। ধোপার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ায় তাকে আবহাওয়ামন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন রাজা। ধোপা বলে, আমার নয়। সব কৃতিত্ব আমার গাধার। যেদিন ঝড় হয় সেদিন ভোর থেকে ওর লেজ খাড়া হয়ে থাকে। তা দেখে আমি সবাইকে সাবধান করি।
‘তাহলে তোর গাধাকেই আবহাওয়ামন্ত্রী করলাম।’ ঘোষণা করেন রাজা। ধোপা আর রাজার এই কাহিনি সবাই জানি। এর সঙ্গে একটা পর্যবেক্ষণ জুড়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিক তারাপদ রায় আমাদের চিন্তাযন্ত্রকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিলেন। তিনি লিখলেন- সেই যে উচ্চপদে গাধাদের বসা শুরু হয় সেই ট্র্যাডিশন চলছেই। কবে যে থামবে, কে যে থামাবে, কোনো দিশা মিলছে না।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন