অকৃতজ্ঞ, অসতর্ক সমাজ ও সময়ের এগিয়ে চলায় পিছিয়ে পড়ছে মানবতা, মূল্যবোধ এবং আদর্শিক অবস্থান। সবার। শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং আলী খামেনিরা নন, নন ভøাদিমির পুতিন কিংবা জেলেনস্কি, বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন সাধারণ মানুষ মুকুল ব্যাপারীও। মুকুলের বার্থ সার্টিফিকেট নেই, এনআইডিতে বাবা-মায়ের নামের বানান ভুল, তার দুস্থ ভাতার পুরো টাকা সে পায় না। এবার মাত্র ৫০ টাকা বেড়েছে। তার অতিসামান্য জমিজমাও চালাকেরা চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। ইসরায়েলের সুরক্ষিত শহরে ইরানের মিসাইল কখন কীভাবে আঘাত হানে মুকুল তার কোনো খবর রাখে না। তবে তার দেশ ও সংসারে মতানৈক্যের মিসাইলের আঘাতের খবর হয় যখন-তখন। প্রচারসর্বস্ব জিডিপি পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় যখন ২ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার, মুকুলের তখন বাজারসদাই করারই পয়সা পকেটে থাকে না।
মুকুলের পূর্বপুরুষেরা ছিল মস্ত ধনী, ব্যাপারীদের হাতে তখন অনেক টাকা। ভৈরবে বড় বজরা নৌকায় সওদাপাতি নিয়ে চাঁদপুরে ফেরি করত তার দাদা মফিজ ব্যাপারী।। মফিজ ব্যাপারীর সুন্দরী বউ চার পোলা জন্ম দেওয়ার পর যেদিন সাপে কাটল, সেদিন থেকে ব্যাপারীদের দুর্দিনের শুরু। আজ এটা যায় কাল সেটা- এভাবে সত্তরের বড় ঝড়ে ব্যাপারীর বজরা ডুবে যায় মেঘনার বুকে ভরা জোয়ারের সময়। পুঁজিপাতি সব শেষ। মুকুলের বাপ শফিক ব্যাপারীর বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। সে সময় দেশে বাধে বেজায় গোলযোগ। যুদ্ধের পর শফিক ব্যাপারী মারা গেলে ছোট তিন ভাইকে নিয়ে মুকুল সংসারের হাল ধরে। তার লেখাপড়ার সুযোগ শেষ। সেই বড় কঠিনকালে ছোট ভাই সাদিক হারিয়েই গেল আরেক গন্ডগোলের বছর। ১৫ বছর পর পর পট পরিবর্তনের সুযোগ শুরু হয় তার দেশে। কে ঠিক কে বেঠিক সেটি ঠিক করতে করতে সময় যেমন বেড়েছে মুকুল ব্যাপারীর কপাল ক্রমশ তত পুড়েছে।
ব্রিটিশ আঁতেল আমলা উইলিয়াম হান্টার যেমন লিখেছিলেন, কীভাবে মাত্র ১০০ বছরের ব্যবধানে ভারতবর্ষে মুসলমান সমাজ ও সম্প্রদায় রাজসিক অবস্থান থেকে গরিবি হালতে চলে যায়। অমর্ত্য সেন প্রমুখেরা দেখিয়েছেন কীভাবে সম্পদ ও কৃষি-বাণিজ্য বৈভবের বাংলা অঞ্চল মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়েছে, যারা এখন শুধু অদক্ষ শ্রমিক হয়ে বিদেশে গিয়ে স্বদেশে সর্বভুক অর্থনীতির জন্য রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। মুকুল ব্যাপারী দেখছে তার চোখের সামনে কীভাবে ধনী আরও ধনী হয়েছে এবং গরিব আরও গরিব। মুকুলের সমাজ ও অর্থনীতিতে গরিবেরা রাঁধে-বাড়ে আর বড় লোকেরা তা খেয়ে সাবাড় করে। গরিবেরা সুদ ঘুষ দিয়ে ধনীদের সম্পদ বাড়ায়, সেই সম্পদ ধনীরা বিদেশে পাচার করে, দেশের টাকা বিদেশে বিনিয়োগ হয়, সেখানে কর্মসৃজন হয়, তাদের উৎপাদন বাড়ে। দেশে অদক্ষ ও অপুষ্টিতে ভোগা শ্রমিকের বেকারত্ব বাড়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ যেমন মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতিকে উন্নততর করার জন্য নয়, তেমন স্বাস্থ্যসেবাকে আমজনতার দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পরিবর্তে নগর ও ক্লিনিকের ভাগাড়ে নিয়ে তো যাচ্ছেই, উন্নত চিকিৎসা ও সুশিক্ষার জন্য বিদেশে অর্থ পাচার চলছেই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নামতে গিয়ে সেই যে পাঠবিমুখ রয়ে যাচ্ছে টগবগে তাজা তরুণেরা, তারা বিনা পরীক্ষায় পাস করতে চাচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার যেখানে গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষা লাভ, দক্ষতা অর্জন, সেখানে নিজেরা নিজেদের বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, দেশের চাকরির বাজার বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে। লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান না করে দেশের টাকা বিদেশে বিনিয়োগ করে সে দেশের ধনীর ক্লাবে নাম লেখানোর তৃপ্তি অনেকের চোখমুখে। সেই টাকা দেশে ফেরত আনার কোশেশে বাদ সাধছে লুট করা টাকায় আইনের আশ্রয় চেয়ে, তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়। চোরকে চোর বলা যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা যাবে না।
অসম্ভব বেআইনি কাজ করে এখন আইনের আশ্রয় নেওয়ার ধুম পড়ে যাচ্ছে। মৌলিক অধিকার হরণকারীরা মৌলিক অধিকার লাভের জিকির তুলছে। যারা বিচ্যুত করেছে মানবাধিকার, ন্যায়নীতিনির্ভরতা থেকে তাদের সমর্থনে অন্তর্ভুক্তির বয়ান আওড়াচ্ছে সবখানে ও ক্ষেত্রে, ঘাপটি মেরে বসে আছে অন্তর্ঘাত সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে। আপনা মাঝে শক্তি সঞ্চয় করা ছাড়া মুকুল ব্যাপারীদের উপায় নেই। কেননা এ মুহূর্তে মূক, অন্ধ ও বধির হয়েও তাদের অন্তর্চোখে এটা দেখতে হচ্ছে বা হবে কেন এবং কীভাবে (১) সর্বত্র দুর্নীতির সুগার বাড়িয়ে গোটা সমাজকে ডায়াবেটিসের রোগী বানানো হয়েছে, (২) শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেশ ও জাতিকে মেধাশূন্য বোকার স্বর্গে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে, (৩) রাজনীতি ও ক্ষমতার মসনদকে নতুন নতুুন শর্তে ও সাবুদে বন্দোবস্ত দেওয়া-নেওয়ার মহড়া বেগবান করা হচ্ছে, (৪) স্বাস্থ্যসেবা খাতকে নিজ ঘরে হাতুড়েনির্ভর ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে বিদেশে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে, (৫) আন্দোলন তথা তীব্র প্রতিবাদের পথ ও পন্থাকে পঙ্কিলতার ছাপছোপ লাগিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে নিরুৎসাহ করার চল চালু হচ্ছে, (৬) অন্তর্ভুক্তির নামে বিচুুতিই বাড়ছে, (৭) সততা, দক্ষতা ও জনসেবা এবং আত্মমর্যাদাবোধ বিকাশের পথ রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র জ্যামিতিক হারে বাড়ানো হচ্ছে, (৮) সিন্ডিকেট ষড়যন্ত্র তৈরিতে শক্তিমত্তা দেখানোতে পিছিয়ে নেই, (৯) রক্ষক অতিমাত্রায় ভক্ষকে পরিণত হচ্ছে, (১০) নিরাপত্তাবিধায়ক নিজেই হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে সর্বজনীন নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। মুকুল মনে মনে ভাবে আদি পিতা-মাতাকে স্বর্গচ্যুতি ঘটানোয় শয়তান ষড়যন্ত্রের যে বীজ বপন করেছিল তা যেন সর্বত্র সর্বব্যাপী হিসেবে বিদ্যমান। এটা যেন প্রকৃতির অমোঘ বিধান যে- ষড়যন্ত্র চলছে চলবে, একইভাবে একই সময় সুশাসনের সন্ধানে, বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশের সপক্ষে জনতার সংগ্রামও চলছে চলবে। মুকুল তার জীবনের গোধূলিবেলায় অস্থায়মান লগ্নে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। তবে তাতে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকার অবকাশ নেই। আপনা মাঝে শক্তি ধরতে, নিজেরে জয় করার ব্রত নিয়ে জুলাই বিপ্লবের অনির্বাণ শিখা জ্বালানোর কাজে তাকে জয়ী হতেই হবে। শুধু রিহার্সাল নয়, প্রতিরোধের প্রতিশোধনের চেষ্টাও একই সমূলে বেগবান রাখার অনিবার্যতাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। শত শহীদের কাছে এ প্রতিজ্ঞা।
মুকুল যদিও দেশের রাজধানী থেকে ঢের দূরে অবস্থান করে, রাজধানীতে (যেখানে রাজা-বাদশাহ ও ঘসেটি বেগমদের বিচরণ) ঘটে যাওয়া আন্দোলনের ঢেউ তার পর্ণকুটিরে কদাচিৎ পৌঁছানোয় ইদানীং মুকুলরা তার আঁচ অনুভব করতে শুরু করেছে। জুলাই ঘোষণা কেন এবং কী তার মর্তবা, জজবা মুকুলরা জানতে বা বুঝতে না পারলেও এটা উপলব্ধি করছে যে ব্যাপারটা বিষদ বোঝাপড়ার বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে। কেননা ঘটনার কারণ ও কার্যকরণ (Cause and effect) একই সমতলে সংস্থাপিত না হলে বিপদ ও বিপত্তির সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। মুকুল সেদিন শুনছিল চায়ের দোকানে মনু চাচা খবরের কাগজ পড়ে বোঝাচ্ছিলেন। চায়ের দোকানের সবাই কি এক ব্যাপারে শুনে বলাবলি করছিল তাই তো! তাই তো!
অর্থাৎ যে যার খবর তারা রাখে না, অথচ যা একটা মস্ত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে সবার কাছে, তা যেন সবার মাথাব্যথার কারণ না হয়ে দাঁড়ায় তা দেখতে হবে। মুকুল ভাবে বারবার বড় ভুল করা সমীচীন হবে না জেনেও মাথার ওপর যারা থাকেন, তারা কেন সেই সমস্যার সাগরে ঝাঁপ দিয়ে থাকেন? দেশের লাখো কোটি টাকা বলা না কওয়া না, সরিয়ে নিয়ে গেল- তাদের ধরার কি কোনো পথ নেই? তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা কি সত্যিই কঠিন? সাধারণ আমানতকারীরা কোথায় দাঁড়াবে? তাদের টাকা কেউ নিয়ে যাবে, তাদের রাষ্ট্র বা ব্যবস্থাপনা ধরতে না পারলে, একে অন্যকে দোষারোপ করতেই থাকবে? দোষারোপের দ্বারা আমানতকারীর অন্তত আসল টাকা উদ্ধারের প্রয়াস ঘেরাটোপে আটকে যাবে? দুর্নীতিই দুর্নীতির উৎস তা কেন বারবার প্রমাণিত হতে থাকবে?
লেখক : অনুচিন্তক