কে না সুখী হতে চায়? সুখ কেবল মানুষের জন্য নয়, পশুপাখির জন্যও। তবে সাধারণভাবে মানুষের সুখ বিভিন্ন বিষয়, ফলাফল এবং উৎসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে। একজন ক্ষুধার্ত মানুষ, যদি একটুখানি খাবার পায়, তাহলে অবশ্যই খুব খুশি হয়ে ওঠে। এই যে মিডল ইস্টে গাজাবাসী বিশেষ পরিস্থিতির কারণে না খেয়ে মরেই যাচ্ছে- এক টুকরো রুটি তাদের ক্ষণিক সুখ এনে দিতে পারে। তাই তো সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্ষুধার্ত মানুষের একটি প্রাণবন্ত ছবি এঁকেছেন :
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’/ যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নিয়ার ওয়ারেন বাফেট এবং বিল গেটসের মতো দানশীল ব্যক্তিরা বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াচ্ছেন এবং মানুষের শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা সমৃদ্ধ করছেন যাতে তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে পারে। এরাই হয়তো প্রকৃত সুখী। বিশ্বজুড়ে অনেক বিলিয়নিয়ার আছেন, এমনকি বাংলাদেশেও কিন্তু সবারই বাফেট এবং গেটসের মতো মনোভাব নেই। তবে আমি ভারতের একজন বিলিয়নিয়ারকে খুঁজে পেয়েছি, যিনি সম্প্রতি ৮৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি রতন টাটা নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। পাঠকদের কাছে হয়তো বাজারজাত প্রথম সস্তা টাটা ন্যানো গাড়ির কথা মনে আছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোটিপতি নন। কারণ তিনি তাঁর বেশির ভাগ অর্থ একটি ট্রাস্টকে দান করেন, যা জনহিতকর কার্যকলাপ দেখাশোনা করে।
একবার রতন টাটার এক বন্ধু তাঁকে একটি আশ্রমের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্য ২০০টি হুইলচেয়ার দান করতে বলেছিলেন। ‘অবশ্যই’, তিনি প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন। যখন সময় এলো, তখন তাঁর বন্ধু বললেন, আমার সঙ্গে এসে নিজের হাতেই ওদের হুইলচেয়ারগুলো দান করো।
তাই তিনি গিয়ে ২০০টি হুইলচেয়ার পৌঁছে দিলেন, আর বাচ্চারা আনন্দে হুইলচেয়ারে চড়ছিল এবং অকল্পনীয় আনন্দে রতন টাটাও অত্যন্ত খুশি। হঠাৎ একটি ছেলে এগিয়ে এসে তাঁর পা ধরে বসে পড়ল।
টাটা জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে তোমার? তুমি আরও কিছু চাও?
না স্যার, আপনাকে স্পর্শ করে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং আমি খুব কাছ থেকে আপনার মুখ দেখতে চাই, যাতে করে মৃত্যুর পর স্বর্গে আমাদের দেখা হলে, আমি আপনাকে চিনতে পারি এবং আবার ধন্যবাদটা জানাতে পারি। ছেলেটির কথা শুনে রতন টাটা বেশ হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে প্রকৃত সুখ বস্তুগত সম্পদে নয়, অন্যদের সেবা করার মধ্যেই নিহিত।
মি. রতন টাটার পুণ্য আত্মার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবনত শুভকামনা। অন্যদিকে গেটস এবং বাফেট প্রকৃত সুখের ধারণা সম্পর্কে কী বলেছিলেন? বিল গেটস বলেছিলেন, ‘প্রকৃত সুখ আসে প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, উদার হওয়া এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে। অন্যদিকে ওয়ারেন বাফেট বলেছেন যে প্রকৃত সুখ আসে আপনি যা ভালোবাসেন তা করার মাধ্যমে এবং সেই সঙ্গে আপনার জীবনটা উপভোগ করা উচিত।’ আমি ভাবছি আমাদের ধর্মগুলো প্রকৃত সুখ সম্পর্কে কী বলে। বাইবেল অনুসারে এককথায়, ‘প্রকৃত সুখ হলো ঈশ্বরকে জানা, তাঁর অনুগত থাকা এবং তাঁর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আসে।’ মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন অন্যদের প্রতি সদয় হতে স্মরণ করিয়ে দেয়; এটি একজন ব্যক্তিকে আরও সুখী করে তুলতে পারে।
আমি হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ গীতার একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা পেয়েছি, যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘প্রকৃত সুখ কেবল একটি শান্ত মন থেকেই উদ্ভূত হতে পারে, যা কোনো বহিরাগত এজেন্টের ওপর নির্ভরশীল নয় এবং প্রতিটি পরিস্থিতিতে অস্থির থাকে’ এবং একই সঙ্গে, তিনি তিনটি ভিন্ন সুখের বর্ণনা দিয়েছেন- বিশুদ্ধ সুখ : এটি আত্মার উত্থান থেকে উদ্ভূত হয়। এর জন্য প্রচুর শৃঙ্খলা প্রয়োজন এবং এটি শুরুতে বিষের মতো মনে হয় কিন্তু শেষে অমৃত।
ফলাফলমুখী সুখ : এটি এক ধরনের স্থায়ী সুখ নয় বরং ক্ষণস্থায়ী।
অলস সুখ : এটি প্রকৃত সুখ নয় বরং আনন্দের একটি ক্ষুদ্র অনুভূতি। আমার একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধু সর্বদা উল্লেখ করেন যে আমি ধনী না হলেও একজন অতীব দানশীল মানুষের মতো। অন্যের সুখ আমাকে সত্যিকার অর্থে সুখী করে। আমি বাংলাদেশে থাকাকালে যখনই রিকশা চড়তাম, গন্তব্যে পৌঁছে ভাড়া জিজ্ঞেস করতাম। রিকশাওয়ালার চাওয়ার দ্বিগুণ-তিন গুণ দিয়ে দিতাম। আমার সুখটা ওখানেই। ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট সুখানুভূতি।
মহাত্মা গান্ধী একটা খাঁটি কথা বলেছেন, যা বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিবিদদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য : ‘সুখ তখনই হয় যখন তুমি যা ভাব, যা বলো এবং যা করো তার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে।’ কতজন রাজনীতিবিদ তা করে থাকে? সে যা-ই হোক, আমি বলি মনে শান্তি থাকা মানেই প্রকৃত সুখ ও সুখী মানুষ।
লেখক : ইমেরিটাস প্রফেসর, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, মিসিসিপি, যুক্তরাষ্ট্র
ইমেইল : [email protected]