শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

জিয়া ঠান্ড মাথার খুনি- হাই কোর্ট

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে জিয়ার যোগসাজশ ছিল- মওদুদ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

জিয়া ঠান্ড মাথার খুনি- হাই কোর্ট

ওপরে উল্লিখিত কথাটি হাই কোর্ট বিভাগ ‘মো. আনোয়ার হোসেন এবং অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়ে উল্লেখ করেছিলেন ২০১১ সালের ২২ মার্চ। রায়ে হাই কোর্ট বিভাগ বলেছেন, ‘সেই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করাকে কি ঠান্ডা মাথার খুন ছাড়া অন্য কিছু বলা যায়? আমাদের উত্তর হচ্ছে, তিনটি কারণে একে ঠান্ডা মাথার খুন বই কিছু বলা যায় না। প্রথমত, যখন আইনবহিভর্‚তভাবে কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেটি অবশ্যই খুন, দ্বিতীয়ত, এটি খুন, কেননা যেদিন তথাকথিত ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরের প্রহসনের বিচার হয়েছিল, এমনকি সেদিনও যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনয়ন করা হয়েছিল সে অভিযোগে ফাঁসির বিধান ছিল না, তৃতীয়ত, প্রহসনের বিচার শুরুর বহু আগেই জিয়াউর রহমান তাহেরের মৃত্যুদন্ড নির্ধারণ করেছিলেন, যে কথা জিয়ার অতি ঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার বইয়ে শুধু লিখেনই নি, বরং আমাদের সামনে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, যে কথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিপসুলজ আমাদের সামনে প্রদান করা সাক্ষ্যে বলেছেন। তা ছাড়া ব্যারিস্টার মওদুদ এবং লরেন্স লিপসুলজের ভাষ্য অনুযায়ী, কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশ আগেই ধার্য করায় জিয়া এই ফাঁসির মূল কুশীলব হওয়াই সত্য, যেহেতু সে আর জীবিত নেই, এই হত্যাকান্ডসহ অজস্র হত্যাকান্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততা যাচাই করা বাঞ্ছনীয়। তদুপরি ব্যারিস্টার মওদুদের বইয়ের ৩৩ পৃষ্ঠার লেখা অনুযায়ী জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখতেন বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা যাচাই করার জন্যও একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিশন গঠন করা অপরিহার্য।’

শুধু ওপরে উল্লিখিত মামলায়ই নয়, জিয়ার অপকর্মসমূহের ফিরিস্তি হাই কোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ ‘বাংলাদেশ মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড বনাম বাংলাদেশ সরকার’ মামলায়ও উল্লেখ করেছেন, যার কিছু অংশ নিম্নে বাংলা তরজমা করে হুবহু প্রকাশ করছি :

(ক) ‘আমাদের বিবেচনার জন্য মূল প্রশ্নটি হলো সংবিধানের তথাকথিত পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে খন্দকার মোশতাক, প্রধান বিচারপতি সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রক্ষাকবচ দিতে পারে কিনা, যেহেতু এই তিনজনের কারও-ই রাষ্ট্রপতি হওয়ার আইনগত যোগ্যতা ছিল না?’

(খ) ‘মোশতাক, সায়েম, জিয়া সবাই সামরিক ফরমান দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, যেগুলো জনগণকে ভীতির মুখে মানতে বাধ্য করা হয়েছিল। এগুলো সবই ছিল অবৈধ। তথাকথিত সামরিক আইনের প্রবক্তরা ভালোই জানতেন যে, এগুলো সবই ছিল বৈধতাহীন। তাই তারা তাদের দুষ্কর্ম ধামাচাপা দেওয়ার জন্য একটি তথাকথিত জনমত যাচাইয়ের প্রহসনে নেমে ছিলেন যা অতীতে আর এক সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানও করেছিল।’

(গ) ‘কখনো কখনো এসব সামরিক স্বৈরশাসকগণ সংবিধানকে অকার্যকর করে ঘোষণা দেন, আবার কখনো সংবিধানকে সামরিক আইনের অধস্তন করা হয়, যা মোশতাক, সায়েম এবং জিয়া করেছিলেন। তারা সবাই বুদ্ধিমান লোক বিধায় খুব ভালো করেই জানতেন, তাদের ঘোষিত সমস্ত ফরমান এবং তাদের সমস্ত কর্মকান্ডই ছিল বেআইনি। তাই তারা তাদের সব অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করেছে সংবিধানকে তছনছ করে খন্ডবিখন্ড করার পর। এতসব তারা নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য করেছে প্রতারণার মাধ্যমে, একান্তই তাদের কুমর্জি ব্যবহার করে।’

(ঘ) ‘আমরা ওপরে বলেছি, কীভাবে খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, এই তিনজন ক্ষমতার জবরদখলদার আমাদের সংবিধানকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে, যে সংবিধান রক্তের অক্ষরে লেখা। তারা সংবিধান রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করেও সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন।’

(ঙ) ‘তৃতীয়ত, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্ত্রবলে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখলদার ছিলেন বলে এবং প্রধান সামরিক শাসক নামক অস্তিত্বহীন পদের জবরদখলদার ছিলেন বলে, সংবিধান পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতাই তার ছিল না। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিলেও ১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই দিন পর তিনি বেআইনিভাবে সংবিধানের এমন সব বিধান খন্ডন করে দেন যেগুলো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার অংশ। এইভাবে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ধর্মরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন।’

(চ) ‘আমরা এও দেখেছি যে, খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোনো ক্ষমতা ছিল না সামরিক শাসন জারি করার, এবং সামরিক ফরমান দ্বারা দেশে রাজত্ব করার।’

(ছ) ‘আমরা এও দেখেছি যেই সংবিধান আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন, তাকে সামরিক ফরমানের অধস্তন করা হয়।’

(জ) ‘আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম কীভাবে একজন মন্ত্রী (মোশতাক), এক প্রধান বিচারপতি (সায়েম) এবং সামরিক বাহিনী প্রধান (জিয়া) সংবিধানকে ধ্বংস করেছে, অপদস্থ করেছে।’

(ঝ) ‘তথাকথিত গণভোট আদেশবলে জিয়াকে ক্ষমতায় বৈধতা প্রদানের যে অপচেষ্টায় ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের অবৈধ আয়োজন করা হয়েছিল, সভ্যজগতে তার কোনো উদাহরণ নেই। জিয়ার অবৈধ এবং অন্যায় কার্যকলাপকে ঢাকার জন্যই ছিল সেই অপপ্রয়াস, যা করা হয়েছিল জনগণের ওপর প্রতারণা ও তঞ্চকতার উদ্দেশ্যে।’

(ঞ) ‘আমরা উল্লেখ করেছি, কীভাবে খন্দকার মোশতাক তার খুনি সামরিক কর্তাদের সহায়তায় ক্ষমতা জবরদখল করেছিল, কীভাবে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন এবং কীভাবে তিনি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি পদে বসার আহ্‌বান করেছিলেন। একইভাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার নিয়োগকালে সেনা আইন অনুযায়ী এই মর্মে শপথ নিয়েছিলেন যে, তিনি সরকারের প্রতি অনুগত থাকবেন, কিন্তু এই তিনজনের সবাই জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সংবিধান লঙ্ঘন করে, সংবিধানকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে।’

‘এটা বিশ্বাস করা যায় না যে, খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়া জানতেন না যে, সংবিধানের ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদ মোতাবেক তারা কেউই রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, তথাপিও এই তিনজনই সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রপতির চেয়ার দখল করেছিলেন সামরিক শক্তিবলে, যার জন্য এই তিনজনের সবাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী।’

(ট) ‘বাংলাদেশে ক্ষমতার জবরদখলদাররা আরও বেশি দূর গিয়েছিলেন। তারা তাদের অবৈধ যাত্রা শুরু করেছিলেন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে। পরে তারা ক্ষমতা হস্তগত করে সামরিক ফরমান জারি করে এবং সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কেড়ে নেয়, যা ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চালায়, যে পরিস্থিতিতে বলা যায় জিয়ার রাষ্ট্রপতির এবং প্রধান সামরিক শাসকের পদ দখল ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ।’

(ঠ) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একই মামলায় বলেছিলেন, ‘সুতরাং খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান, যাকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দেওয়া হয়েছিল, এরা সাংবিধানিক বিধান কার্যকর হতে দেয়নি।’

(ড) ‘খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান যে অপরাধ করেছে তার জন্য তারা তিরস্কার, নিন্দা এবং ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য।’

(ঢ) আপিল বিভাগ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে লিখেছেন, ‘লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ তার স্বীকারোক্তিতে বলেছে, তাহের ঠাকুর যখন খন্দকার মোশতাকের ভাষণ তৈরি করছিল তখন জিয়াও সেখানে উপস্থিত ছিল।’

(ণ) জিয়ার সঙ্গে খুনিদের যোগসাজশের বিষয়টিও আপিল বিভাগ নজরে নিয়ে বলেছেন, ‘তার (লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদের) স্বীকারোক্তিও হাই কোর্ট বিভাগ পূর্ণাঙ্গভাবে লিপিবদ্ধ করেছে। সে (সুলতান শাহরিয়ার রশিদ) শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাত করার ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার যোগসাজশ এবং আলোচনার কথা উল্লেখ করেছে তার স্বীকারোক্তিতে।’

(ত) জিয়া যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে একাত্ম ছিল এবং তাদের সঙ্গে যোগসাজশ রক্ষা করত, সে কথা ব্যারিস্টার মওদুদ তার লেখা বই ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’-এ লিখেছেন, ‘যেসব সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াকে তারা তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়েছিল।’ ব্যারিস্টার মওদুদ তার উল্লিখিত বইয়ে পরিষ্কার ভাষায় এ কথাও লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের যোগসাজশ ছিল।’

১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকা খুনি কর্নেল ফারুকের এক পূর্ণপৃষ্ঠা প্রবন্ধ ছেপেছিল, যাতে সে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার আলোচনার কথা বিস্তারিত উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী, যার সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠতা ছিল, তিনি তার বই ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’তে লিখেছেন, ‘তিনি জিয়ার বাড়িতে লে. কর্নেল ফারুককে দেখে অবাক হয়েছিলেন এবং কথাটি জিয়াকে বললেও জিয়া সদুত্তর দিতে পারেনি।’

তা ছাড়া কর্নেল ফারুক রশিদ লন্ডনের এক টেলিভিশন সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে যা বলেছিল, তা তো গোটা দেশবাসীই জানে।

এত সবকিছুর পরও যারা বলতে চায় জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কুশীলব না, তারা জ্ঞানপাপী বই কিছু নয়। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সে সময়ের মাননীয় প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম মহোদয় লিখেছেন, ‘যারা এসব অপকর্মের কুশীলব, তাদের যথোপযুক্তভাবে সাজা দেওয়া এবং তাদের ঘৃণা করা উচিত, যার ফলে ভবিষ্যতে কোনো উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বেআইনিভাবে ক্ষমতা জবরদখল করতে না পারে।’ মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ কথাগুলো মোশতাক, জিয়া, সায়েম সবার বিরুদ্ধে বলেছেন, যারা সবাই বেআইনি পন্থায় ক্ষমতার জবরদখলদার ছিল। সেটাই হওয়া উচিত, যা নতুন প্রজন্মের মানুষের জানা উচিত।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর