প্রতি বছরের মতো আমাদের মাঝে এবারও ফিরে এলো শান্তি ও মুক্তির দূত মহানবী (সা.)-এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল। এই মাস আমাদের মহানবী (সা.)-এ ধরায় আগমনের শুভ সংবাদ দেয়। বয়ে আনে সব মুসলিমের অন্তরে অফুরন্ত আনন্দ। এ মাসে মহানবী (সা.) সুখ, শান্তি ও ঐক্য-সম্প্রীতির স্বর্গীয় সমাজ প্রতিষ্ঠার সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। এসেছিলেন মহান প্রভুর রাজ্যে তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠার সুমহান দায়িত্ব নিয়ে। তাই এ মাসে তাঁর আদর্শ অনুসরণই হবে আমাদের আনন্দের মূল উৎস। তাঁর আদর্শ অনুসরণে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়াতে পারে একটি জাতি। একমাত্র তাঁর অনুসৃত আদর্শই সর্বস্তরের মানবের ইহ ও পরকালের চিরকল্যাণ বয়ে আনতে পারে। উপহার দিতে পারে আনন্দময় জীবন, বিনয়ী ও আত্মত্যাগী মানব, শ্রেণিহীন-বৈষম্যহীন নির্মল স্বাচ্ছন্দ্য সমাজ। মদিনায় ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে মহানবী (সা.) তা দেখিয়ে গেছেন সবার চোখে আঙুল দিয়ে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কাহিনি, যুগের নামটাই ছিল অন্ধকার জাহেলি সমাজ। মনুষ্যত্ববিবর্জিত বিশ্ববাসীর পাশবিক জীবনের ভয়াবহ বিভীষিকা ও তাদের অমানবিক তাণ্ডবলীলায় বিধ্বস্ত হচ্ছিল জগতের প্রতিটি অঞ্চল। নারীর ছিল না দাবি জ্ঞাপনের সামান্যতম অধিকার। খুন, ধর্ষণ ছিল ওই সমাজে নিত্যদিনের খবর। নগণ্যতম বিষয় নিয়ে হানাহানি-মারামারি চলত যুগ যুগ ধরে। অসহায় মানবতার বুকফাটা রুদ্ধশ্বাসের মধ্য দিয়ে যেন প্রতিভাত হচ্ছিল, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের এই অত্যাচারী জনপদ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করুন! আর আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী প্রেরণ করুন!’ (আননিসা-৭৫)
সুখ-শান্তি, ঐক্য, সম্প্রীতি ও স্বাচ্ছন্দ্যময় স্বর্গীয় সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান প্রভু প্রেরণ করেন মানবতার নবী মুক্তির দূত মুহাম্মদ (সা.)-কে। মহানবী (সা.) ইসলামের অমৃত সুধা পৌঁছে দেন ঘরে ঘরে। ঘোর অমানিশা কাটিয়ে ঐশী জ্যোতিতে আলোকোজ্জ্বল করেছিলেন গোটা সমাজটাকে। নৈতিক অবক্ষয়ের চরম বিপর্যয় রোধ করে, সুখ-শান্তিপূর্ণ একটি সমাজ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আনীত মহামুক্তির পয়গাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। শত বছরের নৈরাজ্যপূর্ণ ওই বিশ্বে প্রবাহিত হয়েছিল ঐক্য-সম্প্রীতি ও সুখ শান্তির ফল্গুধারা। দলে দলে মানুষ এসে তাঁর পতাকাতলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে আরম্ভ করে। তাদের হানাহানি সেদিন রূপ নেয় ভালোবাসায়, কপটতা পাল্টে আসে উদারতা, নিজে না খেয়ে অপরকে খাওয়ানোর শিক্ষাও তারা পেয়েছিল। পেয়েছিল বিনয় ও আত্মত্যাগের পরম শিক্ষা। প্রতিশোধের পরিবর্তে ধৈর্য, সহনশীলতা এবং ক্ষমা করার আদর্শ। শত বছরের শত্রুও সেদিন পরিণত হয়েছিল আপন বন্ধু হিসেবে।
রসুলে খোদা (সা.) একদিকে ছিলেন দিশাহারা মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের খোদায়ী রাহবার। অপরদিকে ছিলেন গণমানুষের মৌলিক চাহিদা এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানকারী মহান রাষ্ট্রনায়ক-খলিফাতুল্লাহ। এমনিভাবে রণক্ষেত্রে ছিলেন সেনাধ্যক্ষ সিপাহসালার। সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে ছিলেন নিবেদিত সমাজসেবক। পারিবারিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ছিলেন অসাধারণ গৃহকর্তা। মানবকল্যাণে তিনি ছিলেন দরদিপ্রাণ। এককথায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি গড়েছিলেন আপামর বিশ্ববাসীর জন্য এক অনন্য আদর্শ। যেখানে অন্যায় নেই। উগ্রতা নেই, শোষণ-নিপীড়ন নেই। নেই স্বজনপ্রীতি ও প্রতিশোধের জঘন্য প্রবণতা। আছে শুধু বিনয়, আত্মত্যাগের বিস্ময়কর কাহিনি, ধৈর্য-সহনশীলতার সচিত্র উদাহরণ। আর উদারতার নির্মল আদর্শ। মহান প্রভুর ঘোষণা- ‘আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ।’ (আলে ইমরান-১০৩)
ইসলাম ধর্ম সংস্কারমূলক উদ্যোগকে সমর্থন করে। সমর্থন করে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের মননশীলতা এবং আখলাক-চরিত্র উন্নয়নে সব সংস্কারমূলক কার্যক্রম। অন্যায়, অনাচার, জুলুম-অত্যাচার ও দুর্নীতি বর্জন করে দিনবদলের কথা বলে ইসলাম। দেয় সব রকম অন্ধকার থেকে আলোর দিকে সংস্কারের নির্দেশনা। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, যারা ইমান আনে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের অভিভাবক তাগুত (মাফিয়া সম্রাট)। তারা তাদের আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। (সুরা আল বাকারা-২৫৭) মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। মানুষের মনমানসিকতা, চিন্তাচেতনা ও আচার-আচরণ, শিষ্টাচার ও পারস্পরিক অধিকার সমুন্নত করার ক্ষেত্রে তাঁর সংস্কার ছিল অবিস্মরণীয়।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা