বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

রাজনীতির কিংবদন্তি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

বোরহানউদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

রাজনীতির কিংবদন্তি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হওয়ার পাশাপাশি শুধু রাজনীতিতেই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের ও গণমানুষের জন্য কাজ করে নিজেকে উৎসর্গ করা সম্ভব। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় বেকারত্ব। দেশের বেকারত্ব হ্রাস করতে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করেছেন তিনি, যা একটুখানি কথা না! আর তার জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, প্রত্যয় ও সংগ্রাম। আর তিনি তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমাদের করেছেন ঋণী। যার কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের অভিভাবক সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যক্তা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। ২০২১ সালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) অর্জন করেছেন।

চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আজীবন দলীয় আদর্শে ছিলেন অটল। রাজনীতিসহ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৫ সালে হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী এবং জমিদার। মাতার নাম খোরশেদা বেগম। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুরনাহার জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। একই বছরে ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওপর পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। আলহাজ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হতো তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউস থেকে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রামের আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান, সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। পরে ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু স্বাধীনতার পর। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে দল পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন ও কারানির্যাতন ভোগ করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানাম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট কিনে তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরমিট মিল কিনে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল)-এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বাবু ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আমি সৌভাগ্যবান, ধন্য আমার জীবন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর অভিভাবকত্বে রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তাঁর সেবা করার সুযোগ পেয়েছি।

লেখক : মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সাবেক একান্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর