বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭২-এর সংবিধানই হোক আমাদের রাজনীতির মূল স্রোতধারা

ফজলে হোসেন বাদশা

মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭২-এর সংবিধানই হোক আমাদের রাজনীতির মূল স্রোতধারা

১৯৭০ সালে সবে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষায় পাস করেছিলাম, রেজাল্টও ভালো ছিল। রাজপথে তখন সামরিক শাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। লেখাপড়ার পাশে সেদিন আরেকটি বিষয় আমার মনে জায়গা করেছিল। সেটি হলো, বাঙালিদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।  আমার জীবনের সব থেকে বড় গৌরব হচ্ছে, সেই অল্প বয়সেই আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ এখন যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই সংকটটি আসলে কী? সেটি আমরা বুঝতে পারছি কি না? এ ক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত, কী করা উচিত না; এসব উপলব্ধি করার সময় এসেছে। আমার একটি বিশেষ উপলব্ধি রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ থেকে কিছুটা সরে এসেছি। আমার বঙ্গবন্ধুর কথা খুব মনে পড়ে। বাহাত্তরের সংবিধানের কথাও মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ’৭২-এর সংবিধান যেদিন পার্লামেন্টে পাস করেন, তখন তিনি সেটির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতি বুঝতে গেলে বঙ্গবন্ধুর সেই বাহাত্তরের সংবিধান কেন আমাদের প্রয়োজন; তাঁর সেদিনের ব্যাখ্যাটি কী ছিল তা ভালো করে অধ্যয়ন করা জরুরি।

বঙ্গবন্ধু সেদিন চার মূলনীতির মধ্যে দুটি নীতি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। একটি সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝায়, আরেকটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমরা কী বুঝি। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র বলতে আমি বুঝি সমতাভিত্তিক একটি সমাজ। বৈষম্যহীন একটি সমাজ। যে সমাজে সবার অধিকার সমান থাকবে এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক হবে এ দেশের জনগণ। আর ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র হবে সবার। এটাও আমরা সবাই জানি। আজকে আমি মনে করি, বাংলাদেশে এ দুটি নীতিই সব থেকে সংকটের মধ্যে রয়েছে। আমরা আসলেই সমতাভিত্তিক সমাজ, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি কি না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে যেভাবে দেখেছিলেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গি আমরা ধারণ করতে পারছি কি না তা-ও উপলব্ধি করা জরুরি। বঙ্গবন্ধু সেদিন যতটুকু ব্যাখ্যা করেছিলেন; সমাজতন্ত্র বোঝার জন্য সেটিই যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হোক।

আরেকটি কথা বলতে চাই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এটি করতে পারলে আজ রাজনীতিতে যে হট্টগোল চলছে, সেই হট্টগোলের ভিতরে আমরা কোন জায়গায় অঙ্গুলি নির্দেশন করব তা নির্ধারণ করা সহজ হবে। আমি মনে করি, বিএনপি যত স্যুট-কোট পরে আসুক না কেন, তাদের ভিতরে রয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ। তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে কী করতে পারে, বাংলাদেশের অতীত রাজনীতি থেকে আমরা তা খুঁজে পেতে পারি। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে গোলাম আযমকে এনে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে পারে, জামায়াতকে বৈধ করতে পারে, বাংলাদেশে তাদের রাজনীতির জায়গা করে দিতে পারে, এমনকি বাংলাদেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যাও করতে পারে। বাংলাদেশের যে চার মূলনীতি আছে তাকেও মুছে ফেলা তাদের জন্য কঠিন কিছু হবে না। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা বলি, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জায়গা লক্ষ্য করে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি করতে পারছি কি না। এ ক্ষেত্রেও আমাদের দুর্বলতা আছে। ব্যর্থতাও আছে। সেই দুর্বলতাগুলো যদি কাটাতে না পারি বা যদি পারি- এর মধ্যকার পার্থক্য কী হবে তা অনুধাবন করতে হবে।

আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে আনি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে আনার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে সামনে আনা। সেটিকে যদি আমরা সামনে আনতে পারি এবং বাংলাদেশ কেন আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম সেই লক্ষ্য আমরা যদি কর্মসূচি হিসেবে সামনে দাঁড় করাতে পারি তবে নিশ্চিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু জনগণকে যদি আমরা উপেক্ষা করে কেবল নিজেদের প্রাধান্য দিয়ে কোনো কাজ করতে চাই তাহলে কিছ্ইু হবে না। জনগণ যদি আমাদের রাজনীতির মধ্যে তাদের স্বার্থ খুঁজে না পায়, নিরাপত্তা খুঁজে না পায়, এমনকি সংবিধানে সব মানুষের জন্য যে অধিকারের কথা বলা আছে সেই অধিকারের কোনো চিহ্ন না পায় তবে তারা আমাদের সঙ্গে আসবে না। আমি এমনকি এও মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নটি যদি সামনে আনা যায় তবে বাংলাদেশের যত বামপন্থি শক্তি আছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বদানকারী শক্তি আওয়ামী লীগসহ সবার মধ্যেই ঐক্য হতে পারে। আগামীতে যে কথাটি আসছে সেটি হচ্ছে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার কথা। যদি আমরা আমাদের রাজনীতি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারি, নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক হয়, সব মানুষ যদি ভোট দিতে পারে এবং ভোটের প্রতিযোগিতায় তাদের আস্থা থাকে তাহলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিই জয়লাভ করবে। কিন্তু যদি মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুগুলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে কর্মসূচি সেগুলো যদি এই রাজনীতিতে প্রাধান্য না পায় তাহলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। আজ মানুষ অনেক বিভ্রান্ত হয়। তারা বিভ্রান্ত হয় শাসনের কারণে। প্রশাসনের কারণে। রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে। সেজন্য রাষ্ট্রটিকেও জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই রাষ্ট্রের মালিক হবে দেশের জনগণ। বর্তমানে রাজনীতির একটি সংকটকালীন মুহূর্তে এ বাস্তব উপলব্ধিগুলো আমাদের অর্জন করা দরকার। একে চর্চা করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমার মনে আছে, আমরা স্বৈরাচারবিরোধী দুটি আন্দোলন করেছিলাম। স্বৈরাচারবিরোধী দুটো আন্দোলন করেছি শুনলে হয়তো আপনারা অবাক হবেন! আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ’৭১-এর বড় খুনি ও রাজাকার ডা. আবদুল বারীকে ভাইস চ্যান্সেলর বানিয়েছিলেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে সেদিন বলেছিলাম, একটা রাজাকারকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। সে লড়াইয়ের জন্য আমাদের কারাগারে যেতে হয়েছিল। নির্যাতিত-নিপীড়িত হতে হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেদিন আমাদের পরাজিত করতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্রদের সাহস ও শক্তি সেদিন আমরা দেখেছিলাম। তারা জিয়াউর রহমানের দুজন মন্ত্রীকে গাছে বেঁধে, বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে সেদিন আটকে রেখেছিল। ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এভাবে রুখে দাঁড়িয়ে এমনই একটি ইতিহাস সেদিন সৃষ্টি করেছিল। শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানকে সেই রাজাকার ভিসি প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল। সেদিন আমি রাকসুর ভিপি হয়েছিলাম, আর জিএস হয়েছিল ছাত্রলীগ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি সেদিন রাকসু দখল করেছিল। সেদিন থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঘাঁটি। আমি মনে করি বাংলাদেশকেও একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সেই ঘাঁটি যদি আমরা গড়ে তুলতে পারি, তাহলে কেবল এই নির্বাচন নয়; বেগম জিয়া, তারেক জিয়ার মতো লোক কোনো নির্বাচনেই ভোট পাবে না। তারেক, খালেদার মতো মানুষ এবং রাজাকার নিজামী, গোলাম আযমদের শিষ্যরা এ দেশে ভোট পেতে পারে- এমন সম্ভাবনা আমি কখনই দেখি না। কিন্তু রাজনীতি যদি সঠিক ধারায় এগিয়ে নিয়ে না যাওয়া যায়, তবে সেই আতঙ্কটি থেকেই যায়।

মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে এক ইঞ্চি সরে আসাও আমাদের জন্য সঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। এখানে আমার রাজনীতির ৫০ বছরের কথা বলা হয়েছে। আমার ৫০ বছর রাজনীতির অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি থেকে এক ইঞ্চি সরে আসাও ঠিক হবে না, এটা ভুল হবে। এ ভুল যদি আমরা করি তাহলে সেই ফাঁক দিয়েই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি আমাদের দাসে পরিণত করতে পারে। বাংলাদেশকে আবার পেছনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।  সেটি যাতে না হয়, সে রকম পরিস্থিতির শিকার যেন আমরা না হই তার জন্য আমাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন থেকে জনগণকে প্রকৃত আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের  প্রত্যাশিত বাংলাদেশের পথে অগ্রসর হতে পারব এবং সেটিই হবে মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নযাত্রা।

লেখক : সংসদ সদস্য, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

সর্বশেষ খবর