শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধানের বীজ সুরক্ষিত থাকুক আগামীর জন্য

শাইখ সিরাজ

ধানের বীজ সুরক্ষিত থাকুক আগামীর জন্য

নানামুখী সংকট নিয়ে পৃথিবী অতিক্রম করছে কঠিন সময়। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব যেমন আছে, আছে মানুষের বহুরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জটিল সমীকরণ। গত ১৫ নভেম্বর বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করেছে। মাত্র ১২ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ কোটি। বর্ধিত জনসংখ্যার এই চাপের পাশাপাশি আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধবিগ্রহের মতো বিধ্বংসী কর্মযজ্ঞ। এসব বিবেচনায় আগামীর খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তিত পৃথিবীর চিন্তাশীল মানুষ। যে কোনো পরিস্থিতিতেই টিকে থাকতে খাদ্যের প্রয়োজন সবার আগে। তাই খাদ্য সুরক্ষার তাগিদ থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে তোলা হয়েছে ফল ফসলের জিনব্যাংক।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও নিরাপদ বীজ সংরক্ষণাগারটি নরওয়ের মূল ভূখণ্ড থেকে ৯৫০ কিলোমিটার উত্তরে স্ ভালবার্ডে গড়ে তোলা হয়েছে। সারা পৃথিবীর খাদ্যশস্যের বীজ নিরাপদে সংগ্রহ করে রাখার এক বিশেষ ভল্ট-‘গ্লোবাল সিড ভল্ট’। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাদ্যশস্য বীজ সংরক্ষণাগার থেকে অন্তত একটি করে হলেও বীজ সংগ্রহ করে, সেগুলো এই ভল্টে রাখা হচ্ছে। এ যেন কম্পিউটারের ডাটা ‘ব্যাকআপ’র মতো করেই গোটা পৃথিবীর খাদ্যশস্যের ‘ব্যাকআপ’। উদ্দেশ্য হচ্ছে যদি প্রাকৃতিক কারণ, যেমন মহাপ্লাবন কিংবা অন্য যে কোনো কারণে, কোনো দেশের কোনো খাদ্যশস্যের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায় তবে তা যেন এখান থেকে সরবরাহ করা যায়। পাহাড়ের ১২০ কিলোমিটার ভিতরে এই ভল্টটি প্রাকৃতিকভাবে অতি ঠাণ্ডার কারণে এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াই শত শত বছর বীজগুলো নিরাপদে থাকবে। ভল্টটিতে শূন্য থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৪৫ লাখ প্রকারের বীজ সংরক্ষণ করা যাবে। গবেষকরা বলছেন, মানব ইতিহাসে, আমাদের খাবারের জোগান দিতে পারে এমন প্রায় ৩০ হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে ৬ থেকে ৭ হাজার প্রজাতি উদ্ভিদের চাষ এ অবধি করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে আমরা বাণিজ্যিকভাবে ১৭০টির মতো ফসলের চাষ করছি। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এদের শতকরা ১২ ভাগ থেকে আমরা পাচ্ছি আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরি এবং পুষ্টি। আমাদের দৈনিক ক্যালোরির প্রায় ৫০ ভাগই আসছে তিনটি ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ ধান, গম এবং ভুট্টা থেকে। ‘গ্লোবাল সিড ভল্ট’-এ সারা বিশ্ব থেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে বার্লির ৭০ হাজার প্রজাতির বীজ, দেড় লাখ জাতের ধানের বীজ এবং ১ লাখ ৪০ হাজার জাতের গমের বীজ। পৃথিবীর সব দেশের শস্যবীজ সেখানে সংরক্ষিত। সেখানে জাতিগত লড়াই নেই, নেই রাষ্ট্র হিসেবে শস্যবীজে ভেদাভেদ, যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি ইউক্রেন-রাশিয়ার শস্যবীজও ওই ভল্টে পাশাপাশি আগামীর নিরাপত্তার জন্য। ১৩ হাজার বছরের কৃষি ঐতিহ্য ভবিষ্যতের শত বছরের জন্য নিরাপদে রাখা হচ্ছে। গত আগস্টে ফিলিপিন্সের লাগুনা প্রদেশের লস বানোস এলাকায় অবস্থিত ইরির সদর দফতরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই সেখানে একাধিকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। ধান গবেষণা নিয়ে নানা সময়ের বেশ কিছু প্রতিবেদন সেখান থেকে তুলে ধরেছি হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে। অন্যান্য বিষয়ের বাইরে এবার ইরির রাইস জিনব্যাংক দেখতে গিয়েছিলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এর আগেও আন্তর্জাতিক রাইস জিনব্যাংকে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এবার দেখতে চেয়েছিলাম রাইস জিনব্যাংকটি কতটা আধুনিক হয়েছে, কতটা পরিবর্তন এসেছে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে।

আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন ইন্টারন্যাশনাল রাইস জিনব্যাংকের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেশন ম্যানেজার অ্যানা কোপে। সঙ্গে তার দুই কলিগ। জিনব্যাংক সিড ম্যানেজমেন্টের সুপারভাইজার মোনাল এবং সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিন কো-অর্ডিনেটর বোরন্যান। পরিচয় পর্বের পর অ্যানা কোপে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল রাইস জিনব্যাংক নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখালেন। যা থেকে জিনব্যাংক সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেলাম।

আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দ্বারা পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রাইস জিনব্যাংকে ১ লাখ ৩২ হাজারেরও বেশি ধানের জাত আছে। যা সংগ্রহ করা হয়েছে ১৩০টির মতো দেশ থেকে। সেখানে সংখ্যাগত দিক দিয়ে বেশি ধানের জাত প্রদান করেছে এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান পঞ্চম। প্রথম হচ্ছে ভারত, দ্বিতীয় লাওস, তৃতীয় ইন্দোনেশিয়া, চতুর্থ স্থানে চীন এবং তারপরই বাংলাদেশ। সেখানে ধানের বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে দুই ধরনের ভল্টে। একটি ভল্টের ভিতরের তাপমাত্রা ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যটির ভিতরের তাপমাত্রা শূন্য থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জিনব্যাংক সিড ম্যানেজমেন্টের সুপারভাইজার মোনাল আমাদের প্রথম ভল্টটির তাপমাত্রা জানালেন ২.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপিনস মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সামুদ্রিক জলবায়ুর অন্তর্গত। ফলে এর আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র। তাই ২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার একটি কক্ষে প্রবেশের আগে আমাদের প্রয়োজন হলো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার। মোনাল আমাদের এনে দিলেন ভারী জ্যাকেট। গায়ে জড়িয়ে প্রবেশ করলাম ভল্টের ভিতর। যত কম তাপমাত্রায় রাখা যায়, ততই বীজের জীবনকাল বাড়ে। ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যে বীজগুলো রাখা হয়েছে অ্যানার মতে সেগুলো টিকবে আগামী ২০ থেকে ৫০ বছর। অ্যানা কোপের কাছে জানতে চাইলাম, কী পরিমাণ জাত বাংলাদেশ থেকে আপনারা পেয়েছেন? বলতে পারবেন?

তিনি বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশের ৬ হাজার ৩ জাতের ধানের বীজ এখানে সংরক্ষণে রেখেছি। ১ লাখ ৩২ হাজার জাতের ধানের বীজের মধ্যে স্থানীয় চাষ করা প্রজাতি, ওয়াইল্ড রিলেটিভস এবং গবেষণায় তৈরি প্রজাতিও অন্তর্ভুক্ত। এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ধানের জাত সংরক্ষণ করা আছে। এত বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহ আর কোনো জিনব্যাংকে নেই। এখানে দুই ধরনের প্যাকেটে বীজ রাখা আছে। ছোট এই প্যাকেটটি দেখছেন। এতে আছে ১০ গ্রাম পরিমাণ বীজ। যে কেউ এই পরিমাণ বীজ নিতে আবেদন করতে পারেন। আমরা পৃথিবীর যে কোনো কৃষক কিংবা গবেষক আবেদন করলে বিনামূল্যে সেটা সরবরাহ করি।’

পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা দেশ থেকে আসা বীজ রাখা আছে একেক সারিতে, একেক র‌্যাকে। বীজের দেশ এবং জাতের পরিচয় সাজানো আছে নির্দিষ্ট কোড দিয়ে। শীতল ঘরটিতে আমি খুঁজছিলাম বাংলাদেশের বীজ। অ্যানার কাছে জানতে চাইলাম, বাংলাদেশি ধানের বীজ কোথায় আছে? পাশ থেকে মোনাল উত্তর দিলেন, ‘র‌্যাক ও প্যাকেট নম্বর ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা আছে। এভাবে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। দাঁড়ান আমি নিয়ে আসছি।’ মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এলেন তিনি। একটা কাগজে র‌্যাক নম্বর ও প্যাকেট নম্বর লেখা। আমি খুঁজতে শুরু করলাম। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল। যেন সারা পৃথিবীর ভিতর খুঁজে পেলাম জন্মভূমি বাংলাদেশকে। এবার দ্বিতীয় ভল্টে যাওয়ার পালা। সেখানকার তাপমাত্রা শূন্য থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বীজ সংরক্ষিত থাকবে ১০০ বছর। অ্যানা আগেই সতর্ক করে দিলেন, মিনিট দুয়ের বেশি ওই কক্ষে থাকা যাবে না। আমি বললাম ৩০ সেকেন্ডের বেশি থাকার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। আমি শুধু একবার বাংলাদেশের বীজগুলো দেখে আসতে চাই। ঢুকলাম হিমশীতল ঘরে। রীতিমতো জমে যাচ্ছিলাম। বরফকুচি জমতে শুরু করেছিল চুলে, মাথায়। এত এত দেশের বীজের ভিতর এই ভীষণ ঠাণ্ডার মাঝে আমরা খুঁজে চলছিলাম বাংলাদেশের বীজ। কিন্তু বাংলাদেশের বীজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নাহ। সম্ভব হলো না। ভীষণ ঠাণ্ডায় টেকা দায়। বেরিয়ে আসতে হলো। হতাশ হলাম। অ্যানা আমাকে হতাশ হতে দেখে বললেন, চিন্তার কিছু নেই। এখানের প্রতিটি বীজ যাদের নখদর্পণে তাদের পাঠাচ্ছি। জিনব্যাংকের দুজন কর্মী বাংলাদেশের বীজ খুঁজতে ভিতরে গেলেন। এই ফাঁকে অ্যানা দেখালেন ওয়াইল্ড রাইসের কিছু জাত। ১ মিনিটের মাঝেই কর্মী দুজন শীতল প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে আনালেন আমাদের দেশের বীজ। যে বীজ আগামী ১০০ বছরের জন্য সংরক্ষিত। আগামী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যতের বীজ নিজ হাতে রেখে আসতে পুনরায় ভীষণ ঠাণ্ডা ভল্টটিতে এলাম। মনে মনে বলছিলাম, ‘প্রিয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, সংকটে খুঁজে নিও ফসলের বীজ তোমাদের জন্য এখানে সঞ্চিত আছে।’

হাজার বছরের কৃষি অনুশীলনের উৎকর্ষেই আমাদের আজকের আধুনিক সমাজব্যবস্থা। বছরের পর বছর কৃষক আগলে রেখেছে বিভিন্ন ফল-ফসলের বীজ। সময় পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে বীজ ব্যবস্থাপনাও। কৃষকের হাত থেকে বীজ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা অনেকটা দূরে সরে গেছে। তাই যে কোনো বৈরী পরিস্থিতির জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রেরই প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। সুরক্ষিত করা প্রয়োজন নিজ নিজ বীজ ভাণ্ডার। পৃথিবীর যে কোনো সংকট-পরবর্তী মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ ফসলের বীজ। সেই বীজ সুরক্ষিত থাকুক আগামীর জন্য।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর