রবিবার, ১২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

কোন পথে চলছেন মমতা দিদি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

কোন পথে চলছেন মমতা দিদি

দেখতে দেখতে ১৩ বছর পার হয়ে গেল। এই ১৩ বছরে তিনি অর্থাৎ বঙ্গেশ্বরী বাংলাদেশ থেকে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেওয়া দূরের কথা, ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছেন। 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতায় স্লোগান দিয়েছিলেন, জয় বাংলা। ’২১ সালের নির্বাচনের আগে তার নির্বাচনী পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, খেলা হবে।   নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তার পায়ে বাচ্চাদের একটি ফুটবল এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার শুরু করেন, আমাকে মেরে ফেলল। এরপর তিনি কয়েক দিন পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে হুইল চেয়ারে ঘুরে বেড়ান। সহানুভূতি আদায় করতেই তিনি এমন করেছিলেন। খেলা হবে তার নিজের তৈরি নতুন স্লোগান বলে তিনি দাবি করছেন। অথচ আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় বিএনপির উদ্দেশে খেলা হবে স্লোগানটি দিয়েছিলেন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে তিনি শুধু দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক নন, অন্যের স্লোগান আত্মসাতের সঙ্গেই যুক্ত। সাম্প্রতিককালে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে গরু ও কয়লা পাচারের হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট) সিবিআই, এনআইএর কাছে এসেছে। কলকাতা হাই কোর্ট কার্যত এখন দিদির মন্ত্রিসভা, দিদির দল, দিদির পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনছে। এমনকি মমতার ভাই কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রী কাজরি ব্যানার্জি আদালতে স্বীকার করেছেন, এক সন্দেহভাজনের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক লেনদেন রয়েছে। এই সন্দেহজনক ব্যক্তি মমতা মন্ত্রিসভার আরও এক প্রভাবশালীর টাকা সাদা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছে।

২০২১ সালের নির্বাচনের আগে যখন গোটা বিশ্ব করোনায় আক্রান্ত তখন বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ তথা ব্যবসায়ী একদিন সকালে চার্টার্ড ফ্লাইট নিয়ে দমদম বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন বর্তমানে জেলে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সচিব। তিনি সরাসরি উঠেছিলেন নিউটাউনের ওয়েস্টইন হোটেলে। মিনিট ২০-২৫ বিশ্রাম নেওয়ার পর তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাদের মধ্যে ১৫-২০ মিনিট কথা হয়। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, সেই অতিথিকে নিয়ে তিনি সল্টলেকের বিকাশ ভবনে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অফিসে যান। সেখানে তারা ঘণ্টাখানেক আলোচনা করেন। তারপর দুজনে মিলে বাংলাদেশের ওই ব্যবসায়ীকে কালীঘাটে মমতার বাড়িতে নিয়ে যান। সে সময় দুটি স্যুটকেস তারা মমতার বাড়িতে রেখে আসেন। এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখন দিল্লির স্বরাষ্ট্র ও বিদেশ মন্ত্রকের হাতে আছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে নাড়াচাড়া দেওয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও গভীরভাবে তদন্ত করার জন্য ভারতের তদন্তকারী এজেন্সিগুলো আসরে নেমে পড়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর ওই ব্যবসায়ীকে মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নতুন একটি বন্দর তৈরি করার ঠিকা তাকেই দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে দেওয়া হবে ভারতের সবচেয়ে বড় কয়লা খনিটিও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গৌতম আদানিকে। আদানিকান্ড নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী তোলপাড়, তখন ভারতের বিজেপি ছাড়া সব দলই রাস্তায় নেমেছে। এই আদানিকান্ড নিয়ে গত ৩ মাস ধরে নানা কান্ড ঘটছে। মোদি আদানি নিয়ে মৌনী বাবা হয়ে বসে আছেন, তেমনি মমতা ব্যানার্জিও আদানি নিয়ে একটা কথাও বলছেন না। দিল্লির এই তিনটি এজেন্সি যখন তৃণমূল নেতাদের একের পর এক জেলে ঢোকাচ্ছে তখন মমতা আদানি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। সব ব্যাপারে মমতা যেমন লাফিয়ে পড়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিলেও আদানির ব্যাপারে চুপচাপ কেন? তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, ইতোমধ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যারা জেলে আছেন, তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তারা কোটি কোটি টাকা তুলেছেন। সেই টাকার বড় অংশ দেওয়া হয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। বিরোধীরা আরও অভিযোগ তুলেছে, কলকাতার দিদিকে দিল্লির দাদা ভয় দেখিয়ে রাখছেন। কারণ আগামী বছরে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে মোদি যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে ১৯৯৭ সালে মমতা যেমন বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারে গিয়েছিলেন, সেই কায়দায়ই মমতা দাদার হাত ধরবেন।

মমতা কী করতে চাইছেন তার কিছু কিছু উদাহরণ এখন প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। তাই অক্টোবর মাসে উপরাষ্ট্রপতি ভোটে মমতা ও তার দল অনুপস্থিত থেকে কংগ্রেস প্রার্থী মার্গারেট আলভাকে ভোট দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে মমতা যে কালীঘাটের ভাষায় বক্তৃতা করতেন, তাও কমিয়ে দিয়েছেন। এখন বলছেন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাই তার সমালোচনা করা উচিত নয়। তবে তিনি বিজেপির সমালোচনা করে যাবেন। একই সঙ্গে তিনি আবার আরএসএসের সমালোচনা করবেন না।

সব মিলিয়ে কলকাতা ও দিল্লির মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছে। বিজেপির প্রবীণ নেতারা দাবি করছেন ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪২টি আসনের মধ্যে ২৪টি বিজেপিকে দিতে হবে। আর ১৮টি আসন তৃণমূল নেবে। ২০১৯-এর নির্বাচনের মতো বাকি কোনো দলকে একটিও আসন দেওয়া হবে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তথা একদা তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী রোজ সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বলে যাচ্ছেন, মমতা এবং তার ভাগ্য অভিষেকের কাছে গরু, কয়লা, বালি, পাথর পাচার, নিয়োগ দুর্নীতি এবং বীরভূম জেলার ৩৭০টি মমতার ব্যাংকে সঞ্চিত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক মমতাই। বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষ রাখঢাক না করেই বলছেন- স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এত বড় দুর্নীতি আগে কখনো হয়নি। যা করেছেন মমতা স্বয়ং। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে আগামী বছর নির্বাচনে কংগ্রেসসহ বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধভাবে সারা দেশে লড়াই করতে পারে। তাহলে মমতার কোনো ষড়যন্ত্রই টিকবে না।

দিদিও কম যান না। ৯ বছরে তিনি কখনই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। বিবিসি সম্প্রতি দুটি তথ্যচিত্র প্রকাশ্যে এনেছে। একটি হলো ২০০২ সালে গুজরাটির মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় নরেন্দ্রভাই মোদির কী ভূমিকা ছিল? ১ হাজারেরও অধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে মারা হয়েছিল। অপর তথ্যচিত্রটি হলো গত ১১ বছরে মোদির কুশাসন। নোটবন্দির সময় মোদি টিভি পর্দায় বলেছিলেন, দেশে প্রায় ৫ লাখ হাজার কোটি কালো টাকা আছে। কিন্তু ১ হাজার কোটি কালো টাকাও তিনি প্রকাশ্যে বের করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি লোককে কর্মসংস্থান দেওয়া হবে। ৯ বছরে ভারতে সরকারি চাকরি পেয়েছেন নগণ্য কিছু লোক। বিবিসির তথ্যচিত্র প্রকাশ্যে যাতে না আসে তা নিশ্চিত করতে আগেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এবার তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দিল্লি ও মুম্বাইতে আয়কর বিভাগকে দিয়ে ৩ দিন ধরে তল্লাশি করানো হয়। লন্ডনের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস সম্পাদকীয় লিখে বলেছে- ভারতের গণতন্ত্র এখন বিপন্ন। ৩ দিন ধরে মোদির আয়কর অফিসাররা বিবিসি রিপোর্টারদের ফোন ও ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে গেছেন। লন্ডন থেকে বলা হয়েছে, ওই তথ্যচিত্র দুটি সম্পূর্ণ সত্যই। আমরা মোদিকে ওই তথ্যচিত্র দুটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করছি। যা বলার আমাদের বলুন। আমরা ওই তথ্যচিত্র দুটি দেখিয়েই যাব।

এক প্রবীণ ব্রিটিশ সম্পাদক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আয়কর বিভাগকে দিয়ে বিবিসির দফতরে তল্লাশি অনেকটা সোভিয়েত কায়দায় ভয় দেখানোর মতো ব্যাপার। তবে বিবিসির তরফ থেকে ওই রেইডের পর বলা হয়েছে, ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থাটি কোনো রকম লক্ষপাতদুষ্ট না হয়েই সংবাদ পরিবেশন করে যাবে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রবীণ সম্পাদক লায়েনেল বারবার বলেছেন, মোদির আয়কর বিভাগের অফিসারদের বিবিসি দফতরে হানা দেওয়ার ঘটনাটা প্রতিশোধমূলক এবং ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যেই করা।  এ ঘটনা আমাদের পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, তিস্তার পানিও মমতা দিলেন না। কাজ দেবেন বলে টাকা নিয়ে সে কাজও দিলেন না।  কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা অধীর চৌধুরীর প্রশ্ন এখনো মমতা ব্যানার্জির প্রতি বাংলাদেশের একাংশের মানুষ যে মোহগ্রস্ত হয়ে আছেন, তার শেষ কোথায়? একই কথা বলেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মুহম্মদ সেলিমও।

                লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর