বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

খোন্দকার দেলোয়ার ও তাঁর নীতিগত দায়বদ্ধতা

মির্জা আব্বাস

খোন্দকার দেলোয়ার ও তাঁর নীতিগত দায়বদ্ধতা

বয়স ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বিবেচনায় অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন আমার চেয়ে সিনিয়র। একই দল করলেও দেলোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে রাজনীতি করার তেমন সুযোগ আমার খুবই কম হয়েছে।  ১/১১-এর পর পরিকল্পিত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য তাঁদের গ্রেফতার করা হয় মিথ্যা ও প্রহসনমূলক মামলার অজুহাত দেখিয়ে। এর আগে এমন একটি ক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্যে বিএনপির অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকে গ্রেফতার করা হয় একই রকমের সাজানো মামলায়। আমাকে যখন গ্রেফতার করা হয় ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকারের হুংকার, তর্জনগর্জন আর উত্তাপে তখন লোহা গলে যাওয়ার উপক্রম। বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার আগে অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করেন। বিএনপির প্রতিটি ক্রাইসিস মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়া সর্বদাই সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্তটি বিএনপির রাজনীতিতে ঐতিহাসিক ও হিরণ¥য় সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হবে বলে মনে করি। জেলখানার ভিতর অসহনীয় অত্যাচার, নির্যাতন, হুমকি প্রদান আর গ্রেফতার নেতৃবৃন্দের বিনা চিকিৎসায় জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার অমানবিক অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকার।

অন্যদিকে বিএনপি ভেঙে টুকরো টুকরো করে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার টার্গেটে বেগম খালেদা জিয়া মনোনীত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ওপর শুরু হয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কড়া নজরদারি। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে নানান ধরনের লোভলালসা ও প্রলোভন দেখানো হচ্ছিল মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু দৃঢ় মনোবল, দল ও দলের চেয়ারপারসনের প্রতি অপরিসীম আনুগত্য, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, নীতি ও আদর্শগত দায়বদ্ধতায় বলীয়ান খোন্দকার দেলোয়ারকে তাঁর নিজস্ব অবস্থান থেকে বিন্দু পরিমাণ টলাতে পারেনি দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা। একপর্যায়ে খোন্দকার দেলোয়ারকে মেরে ফেলার এবং তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকিও প্রদান করা হয়। এসব খবরাখবর প্রকাশিত হয় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়। প্রায় ৭৮ বছর বয়স্ক অসুস্থ খোন্দকার দেলোয়ারকে হাসপাতাল থেকে হাইজ্যাক করে কথিত সংস্কারপন্থিদের দরবারে হাজির করার জন্য সংস্কারপন্থিরা পরামর্শ দেয় সরকারকে। সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে খোন্দকার দেলোয়ারকে হুমকি দিতে থাকে। এমনকি তাঁকে বলা হয়, You will be killed and your family will be destroyed সংস্কারপন্থিদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের কথিত বৈঠকে খোন্দকার দেলোয়ারকে উপস্থিত করে তাঁকে আত্মসমর্পণ করানো এবং বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে খোন্দকার দেলোয়ারের অনাস্থা ঘোষণার প্রহসন মঞ্চস্থ করে বিএনপি তথা পুরো জাতির কাছে বেগম খালেদা জিয়ার ইমেজ ক্ষুণ্ণ করার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগ থেকেই সংস্কারপন্থিদের দরবারে দেশি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে বসিয়েও রাখা হয়েছিল। কিন্তু খোন্দকার দেলোয়ার অত্যন্ত ধৈর্য, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং কৌশলের সঙ্গে এহেন জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। তিনি হাসপাতাল থেকে গোপনে পালিয়ে আত্মগোপন করে সংস্কারপন্থিদের কথিত বৈঠকে উপস্থিত না হয়ে বিএনপিকে রক্ষা করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। খোন্দকার দেলোয়ারের এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন অবশ্যই আগামী দিনে বিএনপির রাজনীতিকে আরও বেশি মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করবে।

একটি বিষয় এখানে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে যে, সারা জীবন খোন্দকার দেলোয়ার যেসব বন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, চিন্তাভাবনা ও মতবিনিময় করেছেন, নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন রাজনৈতিক আলাপচারিতায়; ১/১১-এর পর সেই বন্ধুরা চক্রান্তকারীদের এজেন্ট হয়ে দলের চেয়ারপারসনের গলায় ছুরি বসাতে তৎপর হয়ে ওঠেন সংস্কারপন্থির খোলস পরে। দেলোয়ার ভাই তখন সেই বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন অসীম সাহসিকতায়, আদর্শিক চেতনায়, কৃতজ্ঞতাবোধের ইমানি দায়িত্বে। সংস্কারপন্থি বন্ধুরা হয়তো ভেবেছিলেন পুরনো সম্পর্কের টানে খোন্দকার দেলোয়ার বেগম খালেদা জিয়ার মনোনীত মহাসচিব হলেও গোপনে সংস্কারপন্থিদের দরবারে হাজির হবেন, সংস্কারপন্থিদের তাবৎ অপকর্মের ইন্ধন জোগাবেন। সংস্কারপন্থিদের তল্পিবাহক হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু না, নীতি ও আদর্শিক মূল্যবোধে অটুট, কৃতজ্ঞতাবোধে বলীয়ান, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলমান খোন্দকার দেলোয়ারের কাছ থেকে সংস্কারপন্থিরা তাদের পরিকল্পিত নীচ মানের রাজনৈতিক চক্রান্ত ও কাপুরুষোচিত আচরণের পক্ষে এতটুকু সমর্থন পেল না। তারা হতবাক, বিস্মিত হয়েছিল এ কোন দেলোয়ারকে দেখছে তারা!

দেলোয়ার ভাই দীর্ঘদিন ধরেই হার্ট, ফুসফুস, কিডনিসহ বেশকিছু জটিল রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু তাঁর মানসিক শক্তি ছিল অনেক বেশি। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংস্কারপন্থিদের ন্যক্কারজনক আচরণ দেখে দেলোয়ার ভাই মারাত্মকভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন। অসহনীয় সেই ব্যথার কথা মৃত্যুর আগে আমাকে কিছু বলেও গেছেন। দলের ভিতর সংস্কারপন্থিদের পুনর্বাসন ও দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার কারণে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়বে বলে তিনি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। আমিও একমত পোষণ করেছি।

১/১১-এর পর প্রায় দুই বছর অন্যায়ভাবে আমাকে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেলোয়ার ভাইয়ের কাছে গিয়ে সে সময় তাঁর দায়িত্ব পালনের সততা ও আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কেবলই মনে হয়েছে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালের মধ্যে থেকেও দেলোয়ার ভাইয়ের ইমানের খুঁটি এত মজবুত যে, লোভলালসা, প্রলোভন, হুমকিধমকি তাঁকে তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে বিন্দুমাত্র সরাতে পারবে না। আস্থার আমানতকে খেয়ানত করার মতো নীতিভ্রষ্ট তিনি ছিলেন না। দেলোয়ার ভাই আস্থার আমানতকে আগলে রেখেছিলেন সততা ও বিশ্বস্ততার দুর্ভেদ্য চাদর দিয়ে। বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন অত্যন্ত সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত ছিল সময়োপযোগী এবং নির্ভুল। তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশে, প্রতিহিংসা বা ঈর্ষাকাতর হয়ে কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দল চালিয়েছেন বলে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধাচরণকারী অনেকের শত্রুও হয়েছেন। কারও কারও কঠোর সমালোচনা ও পরিকল্পিত অপপ্রচারের শিকারও হয়েছেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, বিএনপির আগের মহাসচিবদের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে মহাসচিব হিসেবে দেলোয়ার ভাইয়ের দায়িত্ব পালনের ব্যবধানটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কিছু কিছু বিষয়ে। এর মধ্যে যে বিষয়টি বর্ণনায় গুরুত্বের দাবি রাখে তা হলো, অতীতের মহাসচিবরা সরকারি দলে থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের চাপের মুখে ছিলেন। আবার বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সরকারের নানানরকম তোপের মধ্যে থাকতেন। এর বাইরে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু মহাসচিব হিসেবে খোন্দকার দেলোয়ারকে ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকারের প্রচ- চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছে। পাশাপাশি নিজ দলের সংস্কারপন্থিদের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, এমনকি নানানরকম অপবাদ ও অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে। সেই বিবেচনায় মহাসচিব হিসেবে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পথচলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ছিল অতিশয় কণ্টকাকীর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যক্তিগত লোভলালসা, চাওয়া-পাওয়া কিংবা সুযোগসুবিধাকে প্রাধান্য দিলে খোন্দকার দেলোয়ারকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো না। সরকার কিংবা সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে ছলাকলায় মুখরা রমণীর মতো কিছুটা কৌশলী আচরণ করলে খোন্দকার দেলোয়ার হয়তো অনেক নিরাপদে থাকতেন। চৌদ্দ পুরুষের চলাফেরা করার মতো আর্থিক সংস্থানের সোনার কাঠি হয়তো তাঁর নাগালে এসে যেত। কিন্তু এমন গিরগিটি আদলের রাজনীতিতে থুতু ফেলে দেলোয়ার ভাই এগিয়ে গিয়েছিলেন শহীদ জিয়ার আদর্শ সামনে রেখে, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের পতাকা হাতে নিয়ে।

১/১১-এর পূর্বাপর থেকেই লক্ষ করা গেছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা মূলত বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে তথা জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সব রকম পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। যারাই বেগম জিয়ার আস্থা ও বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধেই পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করা হয়েছে। মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই খোন্দকার দেলোয়ারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, দুর্নাম রটনা এবং তাঁকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার যেসব কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল এসবের মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতপক্ষে বেগম খালেদা জিয়ার হাতকে দুর্বল করে দেওয়া, তাঁকে মাইনাস করা।

দেলোয়ার ভাই মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ১/১১-এর চক্রান্তকারীদের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও, নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও শুধু প্রতিহিংসার শিকার হয়ে খোন্দকার দেলোয়ারকে সাজানো অপবাদ ও দুর্নাম হজম করতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করা হয়েছে, বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া হয়েছে সুকৌশলে। তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতাকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তবে সব ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যা রটনা এবং ষড়যন্ত্র চক্রান্ত দুই পায়ে ঠেলে দেলোয়ার ভাই পৌঁছে গিয়েছিলেন দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অন্তরের অন্তস্তলে; যা অনুভব করা কারও কারও সাধ্যের একেবারে বাইরে। দেলোয়ার ভাইয়ের জানাজায় নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের যে ঢল নেমেছিল তাতেই বোঝা যায় নীতি ও আদর্শের বিবেচনায় তিনি কতটা মহৎ ছিলেন, কতটা সফল হয়েছিলেন। দেলোয়ার ভাইয়ের এ সফলতা মূলত শহীদ জিয়ার আদর্শের সফলতা, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের ও সঠিক সিদ্ধান্তের সফলতা। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের সফলতা। এর বাইরে গিয়ে অতীতে কেউ কি সফল হয়েছেন? আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আগামী দিনেও এর বাইরে গিয়ে কারও সফল হওয়ার খায়েশ অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক : ঢাকার সাবেক মেয়র ও মন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

সর্বশেষ খবর