সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিন্দনীয়

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিন্দনীয়

ইসলামী সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। পবিত্র কোরআনে ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।’  (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)। কেনাবেচায় লেনদেনে যেমন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিন্ত হবে তেমনি ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, কুশল বিনিময়, সৌহার্দপূর্ণ সামাজিক বন্ধন এবং একটি মজবুত অর্থনৈতিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে। বিক্রেতা সামান্য লাভে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করবে, ক্রেতা ওই নির্ধারিত মূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনবে এবং উভয় পক্ষই সন্তুষ্টি লাভ করবে। উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রয় করে বেশি লাভের চেয়ে ভোক্তাকে সেবা ও খুশি করতে পারাই হলো প্রকৃত লাভ এবং এতে বান্দার ওপর আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় এভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলে এসেছে যুগের পর যুগ। কিন্তু বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে এ ধরনের কিছুই যেন আঁচ করা যায় না। অধিক মুনাফার হীন উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করে দাম বৃদ্ধি করাই যেন এখন ব্যবসার চরিত্র। আর এ প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যায় রমজান মাস এলে। সাধারণ মানুষ। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দাম নিয়ে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পিঁয়াজ, মরিচ, ডাল, গরম মসলা, চিনি, শাকসবজিসহ নিত্য দ্রব্যগুলোর আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এতে সাহরি ও ইফতারে চরম বিড়ম্বনায় পড়ে রোজাদাররা, সাধারণ মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের সীমা থাকে না। পণ্যসামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে ইসলামে দন্ডনীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা অর্জন করা একটি মারাত্মক অপরাধ। সে কারণে অযথা মূল্যবৃদ্ধি এবং মজুদদেরকে সমাজের লোকেরা ঘৃণার চোখে দেখে।

পবিত্র রমজান মাসে দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; ঠিক সেসময়ই বিশ্বের অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বিশ্বব্যাপী রেকর্ড মূল্যস্ফীতির মাঝেও, ইবাদত বন্দেগির মাসটিতে মুসলিমদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ীরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন ১০ হাজারের বেশি পণ্যের দাম কমিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। মূল্যছাড়ের হিড়িক পড়েছে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ওমানসহ আরও অনেক দেশে। ভোগ্য পণ্যের ওপর ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হ্রাস করেছে তারা। এমনকি কর্মীদের কর্মঘণ্টার ওপরও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধা। যাতে রোজাদাররা সুলভ মূল্যে এসব ভোগ্য পণ্য কিনে আরাম-আয়েসে রোজা রাখতে পারে এবং আল্লাহর দিদার লাভে অধিক মনোযোগী হতে পারে। রোজাদারকে খুশি করা মানে আল্লাহকেই খুশি করা, রমজান মাসে এ ধরনের সেবা করতে পেরে ব্যবসায়ীরাও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে এটাই তাদের একমাত্র কামনা। ইউরোপ-আমেরিকাতেও প্রতি বছর বড়দিন ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে পণ্যের মূল্য হ্রাস করে দেয়। মুসলমানদের পবিত্র রমজানকে সম্মান দেখিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোও বিভিন্ন পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের দেশেই। যেখানে উপরোক্ত দেশগুলো রোজার এক মাস আগ থেকেই এসব পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়, সেখানে আমাদের দেশে রোজা শুরু হওয়ার অনেক আগেই দাম বাড়িয়ে দেয়। প্রশাসন যতই বলে যে রোজায় নিত্যপণ্যের দাম স্মৃতিশীল থাকবে, ব্যবসায়ীরা ততই ডলার ও জ্বালানির অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াতেই থাকে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেক হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ এর কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। সব দায় এসে পড়ে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম সম্মানজনক কাজ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে ইসলাম সব সময় উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কোরআনে বর্ণিত আছে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে আগুনের হাঁড়িতে বসিয়ে শাস্তি দেবেন’ (তাবরানি : ৮/২১০)। অন্য হাদিসে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘যে ব্যক্তি ৪০ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখে, সে আল্লাহ-প্রদত্ত নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায় এবং আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না ’(মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২০৩৯৬)। তিনি এও বলেছেন ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম উপায়ে সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন’ (ইবনে মাজাহ : ২/৭২৯)। কাজেই সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করে ‘বিত্তশালী’ হলেও কোনো লাভ নেই। তার এ অবৈধ সম্পদ যেমন পরকালে জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হবে, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। উপার্জন হারাম হওয়ার কারণে নামাজ, রোজা, হজ, দান-সদকা কিছুই কবুল হবে না।

তবে কিছু ব্যতিক্রমও সমাজের লক্ষ্য করা যায়। কিশোরগঞ্জের দুগ্ধ ব্যবসায়ী এরশাদ উদ্দিন গত তিন বছর ধরে রোজার প্রথম দিন থেকে ১০ টাকা লিটার দরে ৭০-৭৫ লিটার দুধ বিলিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এলাকার রোজাদারদের। বিপরীতে বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও ধনীরা এ ধরনের কিছু কিছু সেবামূলক কাজ করলেও কল্যাণের পরিবর্তে ফেসবুকে ছবি আপলোডকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ঠিকমতো ছবির পোজ দিতে না পারলে দ্রব্য সামগ্রী ফেরত নিয়ে কিল-ঘুসি দিয়ে বিদায় করার দৃশ্যেও দেখা যায়। যা দুর্ভাগ্যজনক।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর