শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

জিয়া অনুসারীদের কেন এত গাত্রদাহ?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

জিয়া অনুসারীদের কেন এত গাত্রদাহ?

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রমের কন্যা, সংসদ সদস্য নাহিদ ইজহার খান সম্প্রতি তার পিতার হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি এজাহার করে শুধু কন্যা হিসেবেই তার দায়িত্ব পালন করেননি, বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করার আরও একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তিনি একটি মহান রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও পালন করেছেন, যার জন্য তিনি এবং তার পরিবার সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।

তাদের এই মহৎ উদ্যোগ দল-মত-নির্বিশেষে আইনের শাসনে বিশ্বাসী এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি নস্যাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সবার কাছেই সমাদৃত। কিন্তু গাত্রদাহ শুরু হয়েছে তাদের, যারা খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল খন্দকার হুদার হত্যার হুকুমদাতা, অর্থাৎ খুনি জিয়াউর রহমানের তল্পিবাহী। তারা বলার চেষ্টা করছেন খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল হুদার হত্যায় জিয়াউর রহমানের হাত ছিল না। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বরের পরে এমন কথা জাতি এই প্রথমবার শুনতে পাচ্ছে, কেননা এই ৪৮ বছর ধরে গোটা জাতির দৃঢ়ভাবে জেনে আসছে যে, সে বছর ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদাসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল খুনি জিয়ার প্রত্যক্ষ নির্দেশক্রমে। এই নতুন সবকটি সে দিন প্রথম দেওয়ার চেষ্টা করলেন কর্নেল অলি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তার মধ্যে যে পরিবর্তন দেখা গেছে, তা আমাদের অজানা নেই। অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সব সময়ই বলে থাকেন রাজাকাররা কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হয়নি, কিন্তু বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তীতে রাজাকার হয়েছেন, এমন উদাহরণ রয়েছে। কথাটি কর্নেল অলির ব্যাপারে প্রযোজ্য। খুনি জিয়া অস্ত্রের বলে ক্ষমতা জবরদখল করার পর যে সব ব্যক্তি জিয়ার থেকে সুবিধা ভোগ করার জন্য খুনি সরকারের কাতারে ভিড় জমিয়েছিলেন, কর্নেল অলি তাদের অন্যতম। যে কর্নেল অলি ৭১-এর ২৫ মার্চ খুনি জিয়াকে পাকিস্তানি সৈন্যদের আজ্ঞাবহ হওয়ার অপরাধে নিজের পিস্তল দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যে কথা প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ১৯৮৫ সালে কলকাতা অবস্থানকালে তার বই, “স্বাধীনতা ৭১” তে বিস্তারিত লিখেছেন, সেই কর্নেল অলিই জিয়া থেকে সুবিধা পাওয়ার পর নিরলসভাবে জিয়া বন্দনা শুরু করেন। তার চেয়েও জঘন্য কাজটি তিনি করেছেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সরকারি ভূমি দখল করে স্থাপনা তৈরি করে, যে কথা ছবিসহ ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকজুড়ে ছাপা হওয়ার পর তাকে মহামান্য হাই কোর্ট আসামি হিসেবে তলব করেছিলেন। তিনি সারা দিন হাই কোর্টে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার পর অপরাধ স্বীকার করে, ক্ষমা প্রার্থনা এবং স্থাপনা ভেঙে দেওয়ার অঙ্গীকার করে হাই কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেই হাই কোর্ট সেদিন তাকে জেলে পাঠাননি। সুতরাং এ ধরনের ভূমিদস্যু কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না।

কর্নেল অলির পর জিয়াকে হুকুমের আসামি করায় যে ব্যক্তি ক্ষিপ্ত হয়েছেন, তার নিজের এবং পারিবারিক পরিচয়, কারও অজানা নেই। একজন চিহ্নিত রাজাকার পুত্র জিয়ার পক্ষে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি এবং কর্নেল অলি উভয়ই বলছেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল হুদার হত্যাযজ্ঞের সময় নাকি জিয়া বন্দি অবস্থায় ছিল। ইতিহাস বিকৃত করতে তাদের জুড়ি কম। কিন্তু ‘সূর্য পশ্চিমে ওঠে’ ধরনের মিথ্যা বলে তারা নিজেদের বা তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অনুসারীদের প্রতারিত করতে পারলেও, জনগণকে বোকা বানাতে পারবেন না। এটি সত্য যে, সে সময় অস্ত্রের বলে ক্ষমতা জবরদখলের কারণে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধপন্থি দেশপ্রেমিকরা জিয়াকে খুবই অল্প সময়ের জন্য কারারুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া কারামুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদাসহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, তার পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশনায়। এসব কথা ইতিহাসের পাতায় পরিষ্কার ভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে, রয়েছে মানুষের স্মৃতির জগতে। মির্জা আলমগীর সাহেব আরেকটু এগিয়ে গিয়ে এমন উদ্ভট কথাও বলেছেন যে, জিয়া নাকি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং খন্দকার হুদা গংদের বাঁচাতে আদেশ দিয়েছিলেন। অনেকেই মন্তব্য করেছেন মির্জা সাহেবদের কথা শোনার পরে পাগলও হাসবে। মির্জা সাহেব মিথ্যাচারের জন্য বিশ্ব পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে যে দাবি করা হয়, তা সত্যিই অত্যন্ত যৌক্তিক বলে আবার প্রমাণিত হলো। সামরিক বাহিনীর রেকর্ড প্রমাণ দেয় যে, সংশ্লিষ্ট সময়ে কর্নেল হুদা বগুড়া সেনানিবাসে দায়িত্বরত থাকাকালে জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেলে সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সেনা সদর দফতর তাকে ঢাকায় এসে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলার পরই তিনি ঢাকায় এসে সেই মহান দায়িত্ব পালনকালে জিয়াভক্ত মেজর জলিল এবং মৃত মেজর আসাদুজ্জামান জিয়ার হুকুম পেয়ে কর্নেল হুদাকে প্রথমে গুলি করে এর পর বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। আসামিদের মধ্যে এখনো জীবিত রয়েছে মেজর জলিল। এত বড় একটি খুনের এবং ষড়যন্ত্রের মামলায় তাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে, এটা সবারই স্বাভাবিক প্রত্যাশা আর তাকে রিমান্ডে নেওয়া হলে সব কথাই বেরিয়ে আসবে। এসব হত্যায় প্রত্যক্ষ চাক্ষুস সাক্ষী ছাড়াও রয়েছে পরিস্থিতিগত সাক্ষ্যপ্রমাণ। তাই বিচারের বাণী নীরবে কাঁদবে না, এটা আশা করা যায়।

জিয়া চাটুকাররা প্রশ্ন তুলেছেন, ৪৮ বছর পরে কেন মামলা? তারা ৯ বোঝেন অথচ ৬ বোঝেন না। খুনি কি কখনো নিজের বিচার চায়। জিয়া তো এসব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে খুন করে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত অত্যাচারী স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার বলেছেন, সংবিধান এবং আইন ভঙ্গ করে জিয়া-মোশতাক-সায়েমের ক্ষমতা দখল ছিল অবৈধ। অতঃপর আরেক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিচারপতি সাত্তার, পরে জেনারেল এরশাদ এবং ঘোর পাকিস্তানপন্থি, জিয়ার স্ত্রী খালেদার আমলেও খুনি জিয়ার নির্দেশপ্রাপ্ত হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সুযোগ ছিল না, যেমন সুযোগ ছিল না বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতার হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করার। এটা ঠিক, ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের দল ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু তাদের স্থায়িত্ব ছিল খুবই সীমিত সময়ের। তখন বঙ্গবন্ধু এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মামলা হলেও তা শেষ করা যায়নি। তা ছাড়া তখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল হুদাদের সন্তানরা শৈশব অবস্থায় থাকায় তাদের পক্ষে মামলা করার অবস্থা ছিল না। তাদের বিধবা স্ত্রীদের পক্ষে শিশু সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর সে অবস্থায় তাদের পক্ষে মামলা করার চিন্তাই করা যেত না। তাই তাদের সন্তানরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরই মামলা করতে পেরেছেন বিধায় এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করতেও তাদের বেশ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। উল্লেখ্য, ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। মৃত জিয়াকে কেন এজাহারভুক্ত করা হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মামলার ধারাবাহিকতা এবং ষড়যন্ত্র প্রমাণে জিয়ার নাম অপরিহার্য। মৃত ব্যক্তির বিচার হয় না ঠিক, কিন্তু এজাহারটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জানান দেবে, জিয়া কতজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলে নিয়ে।

জিয়া যে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার মুখোশ পরে ওপার গিয়ে অতঃপর পাকিস্তানি চর হিসেবে কাজ করেছে, সে কথা অনেকেই বলছেন, যাদের কথায় যুক্তি রয়েছে। গত ১৩ মে বিশিষ্ট কলাম লেখক এবং গবেষক সৈয়দ বোরহান কবীর সাহেবও একটি দৈনিকে বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনিদের নাম উল্লেখ করে জিয়ার কথাও লিখেছেন, যারা মূলত পাকিস্তানি স্বার্থ রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মুখোশ পরেছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম সাহেব তার উল্লিখিত বইতেও লিখেছেন, “২৪ শে মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান নিরুত্তাপেই কাটান। কিন্তু ২৫ শে মার্চের মধ্যরাতে ব্যাটালিয়নের বেশ কয়েকজন সদস্য জিয়াউর রহমানের কাছে নানা ধরনের কঠিন ও ভীতিপ্রদ খবর পৌঁছে দিতে থাকেন। ওই সময়কার চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামরিক বিভাগের অভ্যন্তরীণ সন্দেহ অবিশ্বাস, অসৎ ব্যবহার ও আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের করণীয় কী, জানতে জিয়াকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। ২৫ মার্চের রাত প্রচ- উত্তেজনা ও উদ্বেগের মধ্যে কাটল। ২৬ মার্চ সকালে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকে জিয়াকে ডেকে পাঠানো হলো। নানা কিছু ভেবে জিয়া ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে যাওয়া স্থির করেন। কিন্তু তার কিছু সহকর্মী তাকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে যেতে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন। এত অনুরোধ ও নিষেধ উপেক্ষা করেও তিনি একখানা জিপে ই.বি.আর.সি ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার বেরিয়ে যাওয়ার সময় অষ্টম রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ শিবিরে ছিলেন না। তিনি শিবিরে এসেই কমান্ডার কোথায় জানতে চান। কমান্ডার ই.বি.আর.সি হেড কোয়ার্টারের দিকে গেছেন বলে সৈনিকরা তাকে জানালে ক্যাপ্টেন অলি উন্মাদের মতো একটা মিলিটারি মোটরসাইকেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছোটেন। টাইগারপাসের কাছে তিনি জিয়ার গতিরোধ করে দাঁড়ান। জিয়ার গাড়ির সামনে অলি তার মোটরসাইকেলটি ফেলে দিয়ে চালকের আসনে বসা জিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, স্যার, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? জিয়া স্বাভাবিকভাবেই বললেন, “ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি। ব্রিগেডিয়ার ডেকে পাঠিয়েছেন”। অলি চিৎকার করে ওঠেন, “আপনি এখনো ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন? গেলেই আপনাকে গুলি করবে। আপনি জানেন কি গতকাল ৪০০ বাঙালি রিক্রুটকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে? কুমিল্লা বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাইন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কুর্মিটোলা ও জয়দেবপুর বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনের ওপর ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। এ সমস্ত জানার পরেও আপনি ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন?” “কী করব? ক্যান্টনমেন্টে না গেলে যে কোর্ট মার্শাল হবে।” এবার ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? কীসের কোর্ট মার্শাল? গুলি করে মারবে ওরা। আপনি কিছুতেই ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারবেন না, বলেই ক্যাপ্টেন অলি তার রিভলবার উঁচিয়ে বলেন, “আপনাকে এখনো কমান্ডার হিসেবে মানি। কিন্তু আপনি যদি ক্যান্টনমেন্টে যেতে চান তাহলে আমিই আপনাকে খুন করব। পশ্চিমাদের হাতে গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাঙালির হাতে গুলি খেয়ে মরে অনেক শান্তি পাবেন।” বাঘা সিদ্দিকী আরও লিখেছেন, “ইতিমধ্যেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা বারবার প্রচার করা হচ্ছিল। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দীকি, আবদুল হান্নান, এম এ মান্নান ও অন্য বেশ কয়েকজন নেতা স্বাধীনতার পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই সময় প্রভাবশালী কোনো লোক পাওয়া গেলেই তাকে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান প্রচার করা হচ্ছিল। দু-তিনজন আনসার অ্যাডজুট্যান্ট, পুলিশের সাবেক ডিআইজি এ ধরনের কিছু লোকের আবেদনও প্রচার করা হয়েছে। এর ঠিক পরেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের পেয়ে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে যান। হান্নান সাহেব সামরিক অফিসারদের অনুরোধ করেন। “আপনাদের নেতা বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটা আবেদন প্রচার করুন।” একজন সামরিক অফিসারের আবেদন দেশবাসীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বারবার সামরিক অফিসারদের বুঝিয়ে বলা হচ্ছিল। এত বুঝিয়ে বলা ও অনুরোধ করা সত্ত্বেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ও পাক সামরিক বাহিনীর প্রতি তখন পর্যন্ত অকুণ্ঠ সমর্থক মেজর জিয়াউর রহমানের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটে নাই। বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো বিবৃতি বা আবেদন প্রচারে ঘোর আপত্তি জানান।” শেষে জিয়া ভাষণ পাঠ করেছিলেন, কিন্তু সোজা আঙুলে ঘি ওঠে নাই। বাঘা সিদ্দিকীর লেখা থেকেই পরিষ্কার; এমনকী ২৬ মার্চ পর্যন্ত জিয়ার আনুগত্য পাকিস্তানের প্রতিই ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে জিয়ার ভূমিকা দিবালোকের মতো পরিষ্কার জানান দেয় যে, জিয়া মূলত পাকিস্তানি স্বার্থেই নয় মাস কাজ করেছে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়। আর তাই তার স্ত্রীকেও সেনানিবাসে নিরাপদে বিশেষ মর্যাদায় থাকতে দেওয়া হয়েছিল। সৈয়দ বোরহান কবীর সাহেব যথার্থই লিখেছেন, “প্রত্যেক খুনির সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ৭১-এ জিয়া কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, নাকি পাকিস্তানের নির্দেশে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য?” আরও দর্শনীয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলামী এবং চীনপন্থিসহ সব মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা জিয়াকে তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে তার ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়েছিল। আজও বিএনপি দলের বেশির ভাগ নেতৃস্থানীয় সদস্যের পরিবারের খোঁজ নিলে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের অবস্থান পাওয়া যায়।

জিয়ার তল্পিবাহীরা আবিষ্কার করেছেন, সামনের জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্যই নাকি এই মামলা। মামলাটির সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কী সম্পর্ক থাকতে পারে, তা তারা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। জিয়া যে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন সময়ে হত্যা করেছে, সে কথা তো নতুন কিছু নয়। এই মামলার কারণেই যে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যায় জিয়ার ভূমিকার কথা প্রথম জানা গেল, তা নয়। যাই হোক মামলা হয়েছে, আমরা সুবিচারের প্রত্যাশায় থাকব। বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য যেন মামলাটি দ্রুত বিচারে পাঠানো হয়, বিলম্ব না করে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাও আমাদের প্রত্যাশা। আরও আশা করব, জিয়ার অবৈধ আদেশে আরও যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের উত্তরসূরিরাও যেন এ ধরনের মামলার কথা চিন্তা করেন। তবেই জিয়া প্রতিষ্ঠিত এবং তার স্ত্রী কর্তৃক জিইয়ে রাখা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ মুক্তি পাবে।

 

              লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর