বুধবার, ৩১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরিবেশবান্ধব পর্যটন

সাদিয়া হক

পরিবেশবান্ধব পর্যটন

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তন। বিষয়টি জাতিসংঘ,  বিশ্বের সব দেশ, সমাজ ও সংগঠন, এমনকি ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।  একদিকে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে সবাই শঙ্কিত, অন্যদিকে কীভাবে এ বিপর্যয় রোধ করা যায় অথবা বিপর্যয়ের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে নানান পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, জলবায়ু বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এমন তালিকায় ভ্রমণও রয়েছে। অনেকে হয়তো আমার মতোই কথাটা প্রথমবার শুনে চমকে উঠবেন। কিন্তু নানান তথ্য-উপাত্ত ও সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, অপরিকল্পিত ভ্রমণে অনেক সময় জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণগুলো গতি লাভ করে। জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রতিটি ভ্রমণ পরিবেশের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে ৮-১০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী ট্রাভেল ও টু্যুরিজম খাত। পরিবেশগত অন্যান্য বিপর্যয়ের ওপরও ভ্রমণের সরাসরি প্রভাব রয়েছে।

আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণ-গন্তব্যগুলোর মধ্যে একটি জাঞ্জিবার। ভ্রমণের মৌসুমে ওই এলাকায় ব্যবহৃত পানির পরিমাণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে একটি বাসায় দৈনিক পানি ব্যবহার করা হয় ৯৩ লিটারেরও কম, যেখানে গেস্ট হাউসের একটি রুমে গড়ে ব্যবহার করা হয় দৈনিক ২৯৬ লিটার পানি। আর ওই এলাকায় অবস্থিত পাঁচ তারকা হোটেলের একটি রুমে দৈনিক গড়ে ব্যবহার করা হয় ৩ হাজার ১৯৫ লিটার পানি। আরেকটি তথ্যে দেখা যায়, ভ্রমণের মৌসুমে ভূমধ্যসাগরে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, যা সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু বিপর্যয়ের ওপর ভ্রমণের প্রভাব কতটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ভ্রমণ। বিশ্বের মোট জিডিপির ১০.৪ শতাংশ ট্রাভেল ও টু্যুরিজম খাত থেকে আসে। পাশাপাশি, বিশ্বে বেশকিছু পর্যটননির্ভর দেশ রয়েছে, যাদের অর্থনীতি ভ্রমণের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। যেমন বলা যায়- মালদ্বীপের জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। তার ওপর ভ্রমণ অনেক আগে থেকেই মানুষের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজপাগল মানুষ পাহাড় বা সমুদ্র থেকে বেড়িয়ে এসে আবার সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে কাজে মন দেয়। আধুনিক জীবনের নানান মানসিক চাপ ও বিষণœতা কমানোর উপায় হিসেবেও অনেকে ভ্রমণ বেছে নেন। তবে ভ্রমণের আগে কিছু বিষয় সম্পর্কে আমাদের সবারই সচেতন হওয়া উচিত। ব্যক্তি পর্যায় থেকে আমাদের কিছু পদক্ষেপ একদিকে ভ্রমণসংশ্লিষ্ট দূষণ কমিয়ে আনতে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি টেকসই ভ্রমণ (সাসটেইনেবল ট্রাভেল) নিয়ে জনসচেতনতা তৈরিতেও সহায়তা করবে।

একটি ভ্রমণ সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে সবার আগে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। কোথায় যাচ্ছেন, কীভাবে যাচ্ছেন, কোথায় থাকছেন, কী খাচ্ছেন, কী কী করবেন; ভ্রমণের সময় ঘটবে এমন সব কাজে আপনার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে পরিবেশ দূষণের প্রতিকার। ভ্রমণের সময় এমন কোথাও থাকা উচিত, যারা ইতোমধ্যে জলবায়ু বিপর্যয় রোধে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এমন উদ্যোগের মধ্যে থাকতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা, ভ্রমণের সময় প্লাস্টিকের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, প্রয়োজনে বহুবার ব্যবহার করা যায় এমন প্লাস্টিকের সামগ্রী ব্যবহার করা, থাকার জায়গার কাছাকাছি কোথাও ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে বাইসাইকেল ব্যবহার করা বা হেঁটে যাওয়া।

ভ্রমণের ব্যাগ গোছানোর সময় তা যেন হালকা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দূরের যাত্রার ক্ষেত্রে দেখা যায় ভারী ব্যাগের কারণে বিমান বা বাসের অতিরিক্ত ওজন হয়। আর সেই ওজন পরিবহন করতে গিয়ে অনেক বেশি জ্বালানি খরচ করতে হয়। আবার পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণত দেখা যায় ভ্রমণের ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভ্রমণকারীরা স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় পরিবেশ দূষণ বেশি করে থাকেন। ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে ভ্রমণকারীদের উচিত এমন পণ্য ব্যবহার করা যা বারবার ব্যবহার করা যাবে।

ভ্রমণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকে। খাবারের ক্ষেত্রেও স্থানীয় দোকান ও রেস্তোরাঁর প্রাধান্য দেওয়া উচিত। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাবার গ্রহণ করলে একদিকে যেমন ওই এলাকার অর্থনীতি চাঙা হবে, অন্যদিকে আমদানিকৃত খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্বালানি ব্যবহারও কমে আসবে। স্যুভেনির সংগ্রহের সময়ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। দেখা যায়, বেশির ভাগ স্যুভেনিরই আসলে বিভিন্ন রকম প্লাস্টিকের পণ্য, তার সঙ্গে যুক্ত হয় বড় শপিং মলের অনবায়নযোগ্য জ্বালানি খরচ। আপনার ভ্রমণ থেকে যেন ওই এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা সামান্য হলেও উপকৃত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।

টেকসই ভ্রমণের সহযোগী হওয়া টেকসই ভ্রমণ নিশ্চিত করতে এমন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিন যারা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণে উৎসাহ জোগায়।  এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সাহায্য করার মাধ্যমে টেকসই ভ্রমণের দিকে আপনাকে মনোযোগী করে তোলে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাবার, জ্বালানি-সাশ্রয়ী যাতায়াত, পরিবেশবান্ধব আবাস ও অন্যান্য কাজের মধ্য দিয়ে আপনার ভ্রমণ টেকসই করে তোলে এসব প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও বর্তমানে এ ধরনের অনলাইন প্রতিষ্ঠান  গড়ে উঠেছে, যারা আপনার পরিবেশবান্ধব ভ্রমণের পরিকল্পনা বাস্তব করে তুলবে।

লেখক : সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শেয়ারট্রিপ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর