তুচ্ছ বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া আলাদা ব্যাপার। ভারতে কেবল দুজন প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলে লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচন হয়েছিল একই দিনে। জওহরলাল নেহরুর সময় ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে। তারপর ১৯৬৭ সালে তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সময়।
কেরালায় তুচ্ছ বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় ১৯৫৯ সালে। সে বছর ৩১ জুলাই নেহরু তাঁর মেয়ে কংগ্রেস সভাপতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে কেরালায় নামবুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট জোট সরকারকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেন। রাষ্ট্রপতির শাসন শেষ হয় ১৯৬০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে বিধানসভায় সিপিআইয়ের আসন ছিল ২৯টি, কংগ্রেসের ৬৩টি। সেখানে কংগ্রেস সরকারও গঠন করে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসনোত্তর অবস্থা কেরালার বিধানসভা নির্বাচনগুলোর নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে। যার ফলে আলাদা হয়ে থাকার এ প্রবণতা একটি ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
আলাদা থাকার ভাইরাস ১৯৬৭ সালে মহামারির রূপ নেয়। সে সময় অমৃতসর থেকে কলকাতা এবং তামিলনাড়ু পর্যন্ত ভোটাররা কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে গেল। এরপর কংগ্রেসের স্থলাভিষিক্ত হওয়া বহুমুখী জোট সরকারগুলো তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ আর অহংকারে জর্জর। এতে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখান থেকে দেশ উতরে গেলেও নির্বাচনব্যবস্থা আটকে গেছে। ওড়িশার নেতা নবীন পট্টনায়েক দুই দফা দুটি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যুক্তি খুঁজে পাননি। তাই ওড়িশায় বিধানসভা ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে হলো। এক দেশ, এক রাজ্য, এক নির্বাচন। জাতীয় নেতাদের মতো পট্টনায়েকের জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায়; এর ফলস্বরূপ তিনি তাঁর রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। তাঁর ছিল প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস।
রাহুল গান্ধীর মন্তব্য হচ্ছে, একই দিনে বিধানসভা ও লোকসভা ভোট নেওয়ার প্রস্তাব রাষ্ট্রের ‘ফেডারেল বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী’। তিনি হয়তো অতীত দিনের কাহিনি মনে রাখেননি। ইন্দিরা ও নেহরু কি ফেডারেলবিরোধী ছিলেন? কারণ তাঁরা তো সব নির্বাচন এক দিনেই আয়োজন করেছিলেন।
ভোটাররা ‘বড়’ ও ‘ছোট’ নির্বাচনের পার্থক্য বোঝেন। ২০০৩ সালে বিজেপি বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছিল নির্বাচনে কয়েকটি রাজ্যে জিততে পারলে তিন মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৪ সালে তারা কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে পারবে। ভোটাররা এ ধরনের সুস্পষ্টতার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
ভারত এবং ভারতীয় শব্দ দুটির মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো ভারতীয়। যেমন হয়ে থাকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বা ভারতীয় জনতা পার্টি। ভারতের ধ্বজাবাহী হওয়ার দাবি করাটা অন্য বিষয়। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাস্ত হওয়ার আংশিক কারণ, দেবকান্ত বড়ুয়ার মতো অনুগতরা তাঁকে দেশের সঙ্গে সমতুল্য করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’। এটা ভোটারদের মনঃপূত কথা ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের নাম পরিবর্তন করেননি। যাঁরা তাঁকে অভিযুক্ত করছেন তাঁদের অজ্ঞতাদৃষ্টে হতভম্ব হতে হয়। সংবিধানের শুরুতে বলা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়া, মানে ভারত...’, একটি স্বাধীন দেশের দুটি নাম সমর্থন করে : ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’। সিন্ধু বা ইন্দুস্তান বা হিন্দুস্থানের বাইরের ভূমির জন্য ইন্ডিয়া ছিল সাম্প্রতিকতম পরিবর্তন। দেশের নাম নির্বাচনে ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক অনুরণন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে হিসেবে ভারত নামটি বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৪৯ সালে গণপরিষদে বুদ্ধিজীবী এইচ ভি কামাথের তোলা একটি সংশোধন গৃহীত হলে হয়তো ২০২৩ সালের এই পরিস্থিতি আরও স্পষ্টতা পেত। কামাথ এ দেশের নাম ‘ভারত বা ইংরেজি ভাষায় ইন্ডিয়া...’ পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন।
আমি ভরসা করি বাবাসাহেব আম্বেদকরের ওপর। কারণ তিনি বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া, এটাই ভারত’। তাঁর এ বক্তব্য সমান্তরাল ও বিরোধী নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ভুলে গেলে চলবে না। জাতীয় সংগীতের বাণী যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তবে বলি, তিনি ‘ইন্ডিয়া ভাগ্যবিধাতা’ লেখেননি; লিখেছেন ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’।
প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী ভারত শব্দটি অবাধে ব্যবহার করেছেন। ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং ইন্ডিয়া ও ভারতকে যুগল বিবেচনা করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু তা কেউ লক্ষ্য করেনি। সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো ঘটনা হইচই না ফেলা পর্যন্ত আমরা কেউ জেগে উঠি না।
এ নিয়ে কিছু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া খুবই হাস্যকর। এক নেতা বললেন যে, বিরোধী জোট নিজেদের নাম আবার ‘ভারত’ করে ফেললে সরকার দেশের নাম পরিবর্তন করে বিজেপি রাখবে কি না।
‘ইন্ডিয়া, এটাই ভারত...’ একটি জাতির মহিমাকে বোঝায়, রাজনৈতিক রজনির ভঙ্গুর অংশ নয়। ঘটনাক্রমে আপনার হাসি নিঃশেষ করবেন না। বুমেরাং এখনো বাতাসে আছে।
ব্যবহারিক গণতন্ত্রের দাবি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটের চক্রে একটি নির্দিষ্ট দ্বিবার্ষিক সময়সূচি রয়েছে। ইউরোপে গণতন্ত্র আরও নমনীয় কিন্তু কোনো ইউরোপীয় দেশ বড় বড় প্রদেশ দ্বারা গঠিত নয়।
৫৩ বছরের অবিরাম ‘বিজয়’-এর পর সম্প্রতি আফ্রিকার গ্যাবনে আলি বঙ্গো ওন্ডিম্বা রাজবংশকে উৎখাত করা হয়েছে। তাঁর শাসনামলে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের কোনো হিসাব নেই। এ লুণ্ঠন মূলত প্যারিস থেকে পরিচালিত। চীনের মতো একনায়কতন্ত্রের দেশে কোনো নির্বাচন নেই এবং অনেক রহস্যময় গুম আছে। এ লেখাটি আমি ঢাকায় বসে লিখছি, এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুটা সুস্থিতি এনেছেন। এখানে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে না।
ভারতীয় গণতন্ত্র প্রকৃত, স্পষ্ট, আনন্দদায়ক; কিন্তু এ ছাড়া ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্তিকর। এখানে ঠিকভাবে সরকার চালানো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নির্বাচনী আয়োজনে অনেক সময়ের অপচয় হয়। তাই উচিত হবে : একটি দেশ, একটি নির্বাচন এবং একটি ভোট।
জেনারেল চিয়াং কাইশেক একমাত্র চীনা নেতা যাঁর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর বৈঠক হয়েছিল। অথচ ১৯৪২ সালে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোই হয়নি। কারণ চিয়াং কাইশেক চাইছিলেন মহাত্মা গান্ধী যেন তাঁর স্বাধীনতা আন্দোলন মুলতবি রেখে ব্রিটিশদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় করা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। গান্ধী হয়তো জেনারেল চিয়াং কাইশেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন না যদি না জওহরলাল নেহরু চাপ দিতেন। গান্ধী জানতেন, চীনের উপদেশ আত্মস্বার্থে অনুপ্রাণিত ছিল, দুই দেশের জন্য উপকারী হবে এমন কিছু না।
গান্ধী মাত্র এক দিনের জন্য বা আরও সঠিকভাবে বললে দিবালোকে চীনা অতিথির সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় গিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২ সালের আগস্টে গোয়ালিয়া ট্যাংকে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় কাইশেকের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময়কার অনুভূতি বর্ণনা করেছিলেন। এ অধিবেশনেই ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। গান্ধী বলেছেন, চিয়াং কাইশেক চিন্তায় অগভীর, কোনো অধ্যয়ন দ্বারা পরিস্থিতি বোঝার অযোগ্য। জওহরলাল নেহরুর চীন সম্পর্কে হয়তো আলাদা ধারণা ছিল।
রহস্যের একটি ঝলক : স্টিভ জবস নাকি কোম্পুনোফোবিয়া বা বোতাম আতঙ্কে ভুগতেন। তিনি ডাগর আকৃতির কোনো বোতাম দেখলেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন। সেজন্য শেরওয়ানি পরা অতিথিতে ঠাসা আলিশান ভারতীয় বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ করা হতো না।
আমি নেটে ঢুকলে হঠাৎ করেই এ তথ্যটি পেয়ে যাই। আশা করি এটা কোনো ভুয়া খবর না।
লেখক : প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক ও রাজনীতিক