সাংবাদিক পীর হাবিবের সঙ্গে আমার যখন ঘনিষ্ঠতা হয় তখন সুনাম, সুখ্যাতি এবং সফলতার স্বর্ণ সূর্য তাঁর মাথার ওপর জ্বল জ্বল করছিল। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের দ্বিতীয় শীর্ষ অধিকর্তা ছাড়াও ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে প্রতি সপ্তাহে দু-চারবার দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করার কারণে তাঁকে ঘিরে সংবাদপত্র জগতে এক ধরনের আকর্ষণ আবর্তিত হতো। লেখালেখি ছাড়াও টেলিভিশন টকশো এবং সভা-সমিতি-সেমিনারে তাঁর উপস্থিতিতে তিনি যে দ্যুতি ছড়াতেন এর চেয়েও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল তুমুল আড্ডাবাজ সুহৃদ হিসেবে। তিনি খাওয়াতে ভালোবাসতেন এবং নিজেও খেতে পছন্দ করতেন, আর এ রকম একটি খানাপিনার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি হঠাৎ করেই আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন।
যে সময়ের কথা বলছি তখন আমি, পীর হাবিব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ছাড়াও বন্ধুবর সম্পাদক নঈম নিজামের নিবন্ধ নিয়ে হররোজ পাঠক মহলে হইচই হতো। বঙ্গভবন থেকে গণভবন-সচিবালয় থেকে করপোরেট হাউস এবং ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালারাও আমাদের নিবন্ধ পড়তেন এবং কে কত ভালো লিখেন তা নিয়ে আলোচনা করতেন। ফলে আমাদের সবার মধ্যেই নিদারুণ এক অস্থিরতা কাজ করত ভালো কিছু লিখে পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দেওয়ার জন্য। এ অবস্থায় বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসটি দেশের শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির একটি নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়ে যায়, আর আমরা সবাই সেখানে আবর্তিত হতে থাকতাম।
পীর হাবিবের সঙ্গে আমার অত ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমি তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলাম- আর তিনিও হয়তো আমার লেখা পড়তেন। ২০১১ সালের ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে আমি সময় পেলেই বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে যেতাম সম্পাদকের রুমে। পীর হাবিবের সঙ্গে আড্ডা হতো, কিন্তু সেই আড্ডার সম্পর্কটিকে পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনে তিনি যেভাবে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন তা স্মরণ করলে পীরের বিদেহী আত্মার জন্য নিজের অজান্তে দোয়া চলে আসে।
যে ঘটনা দিয়ে পীরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় সেটি ছিল তাঁর মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। তিনি ফোন করে আমাকে সপরিবারে দাওয়াত করেন এবং আমার পরিবারের পাঁচ সদস্যের সবাইকে নিয়ে আসার অনুরোধ জানান। তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ সম্ভাসন- হৃদয়নিংড়ানো আহ্বান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তির কারণে আমি সে রাতে সপরিবারে গুলশানের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি বিরাট এক এলাহি কাণ্ড চলছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদসহ পীরের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং আত্মীয়-পরিজনের উপস্থিতিতে পুরো অনুষ্ঠানটি একটি তারার মেলায় পরিণত হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে সাজু নামক পীর হাবিবের লন্ডন প্রবাসী এক ভগ্নিপতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। যা কি না পরবর্তীকালে আমার, পীর এবং সাজুর পরিবারের মধ্যে আন্তরিক এক বন্ধন সৃষ্টি করে।
সাংবাদিক হিসেবে পীর কেমন ছিলেন তা বোধহয় আমার মতো অর্বাচীন লেখকের মুখে আলোচনা করাটা শোভনীয় নয়। কারণ তিনি ছিলেন একাধারে সম্পাদক-প্রতিবেদক এবং লেখক। একটি প্রতিবেদনকে উপ-সম্পাদকীয়তে রূপান্তর ঘটানো কিংবা একটি উপ-সম্পাদকীয়র মধ্যে প্রতিবেদনের মাল-মসলা ঢুকিয়ে পাঠক মহলে সাড়া ফেলার যে অনবদ্য গুণাবলি তাঁর মধ্যে ছিল এমন নজির বাংলাদেশের অন্য কোনো সাংবাদিকের মধ্যে আমি দেখিনি। সাংবাদিকতাকে তিনি ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং সাংবাদিকতা পেশাটিকে উপভোগ করতেন। ফলে তাঁর বেশির ভাগ লেখনীর সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের ভাষা প্রকাশিত হতো। পাঠকরা অনায়াসে বুঝতে পারতেন তাঁর নীতি-আদর্শের ধরন এবং প্রকৃতি। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে খ্যাপাটে স্বভাব-বহেমিয়ান জীবন এবং বেহিসাবি চালচলন ও কথাবার্তার যে সুনাম দুর্নাম রয়েছে তা পীরের মধ্যে পুরোদস্তুর বিরাজমান ছিল। ফলে তাঁর হাতে টাকা থাকলে তিনি তা দু’হাতে খরচ করার জন্য রীতিমতো পাগলামো করতেন এবং তাঁর সেই পাগলামোটি কোন পর্যায়ের ছিল তার একটি নমুনা পেশ করেই আজকের লেখা শেষ করব।
ঘটনাটি ২০১৫ সালের। সেবার পীরের মাথায় খেয়াল চাপল যে তাঁর জন্মশহর সুনামগঞ্জে কুড়ি হাজার লোকের এক সমাবেশ করবেন এবং সেই সমাবেশে মেহমান হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনকে দাওয়াত দেবেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ অন্তত ২০ জন মেহমানের সঙ্গে আমাকেও জোর করে সুনামগঞ্জ নিয়ে গেলেন। ঢাকা-সিলেট-ঢাকার ফিরতি বিমানের টিকিট, সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে যাওয়ার জন্য গাড়ি এবং রাত যাপনের সব আয়োজন, খানাপিনা এবং বিনোদনের প্রতিটি আয়োজন ছিল নিখুঁত এবং স্মৃতি জাগানিয়া। দুপুরে পীরের বাড়িতে শতপদের ব্যঞ্জনে হাওরের সব মাছের বাহারি তরকারি, সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পায়েস-ভাজি-ভর্তার যে সমাহার তা আমন্ত্রিত অতিথিরা আমৃত্যু স্মরণে রাখতে বাধ্য। সন্ধ্যার পর মূল অনুষ্ঠান এবং গভীর রাতে হাওরের মাঝখানে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশিত সংগীতের সুর মূর্ছনা উপভোগ করে যখন ঘুমাতে গিয়েছিলাম তখনো পীর হাবিবের নিখুঁত আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
পরের দিন ঢাকায় ফিরে যখন বাসায় গেলাম তখন পীরের কাণ্ড দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। যে রাতে আমরা সুনামগঞ্জে ছিলাম সে রাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের বাসার ঠিকানায় সুনামগঞ্জ হাওরের ঐতিহ্যবাহী মাছ বরফজাত করে কুরিয়ারের মাধ্যমে কখন যে পৌঁছে দিয়েছে তা কেউ জানতে পারিনি। বাসায় ফেরার পর স্ত্রী মহোদয়া যখন সুহাসিনী বদনে বলেছিলেন, পীর ভাই ১২ কেজি ওজনের বিশাল এক বোয়াল মাছ পাঠিয়েছে তখন যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
পীর হাবিব আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর জীবন এবং কর্ম আমার মতো কত মানুষকে যে স্মৃতিকাতর করে তোলে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তাঁর আদর্শ, তাঁর লেখনী, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা হাসি-আনন্দ এবং একান্ত অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোর সান্নিধ্য যারা লাভ করেছেন তাঁদের স্মৃতিতে তিনি অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবেন। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মঙ্গল কামনা করছি এবং তাঁর প্রিয়জনদের জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া করছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য