বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নির্বাচনে বৈধ বনাম অবৈধ অস্ত্র

হোসেন আবদুল মান্নান

নির্বাচনে বৈধ বনাম অবৈধ অস্ত্র

জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলেই অস্ত্র এবং অস্ত্রধারীর হিসাব-নিকাশ শুরু হয়। এটা এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আগ্নেয়াস্ত্রের বেলায় এটা দেখা যায়। দেশে কতজনের হাতে বা তার দখলে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে এর একটা মোটামুটি হিসাব জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে। এমন পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা  সরকারের স্বাভাবিক এবং গতানুগতিক দায়িত্বের অংশ।  এটা পৃথিবীর সব দেশেই অধিকতর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাছাড়া বৈধ অস্ত্রগুলোর হিসাবের সুবিধার্থে একটি নির্ধারিত মেয়াদের পরে এর নিয়মিত নবায়ন (renewe) করার বিধান রয়েছে।

কিন্তু অবৈধ অস্ত্রের এসব প্রয়োজন হয় না। এর আগমন নির্গমন, সংগ্রহ, হস্তান্তর সবই সরকারের হিসাবের বাইরে। এদিক থেকে অবৈধ অস্ত্র এবং অস্ত্রধারীরা বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত (privileged)। অথচ তারাই যুগ যুগ ধরে অস্ত্রের নেতিবাচক ব্যবহার, ক্ষমতা প্রদর্শন, ডাকাতি বা হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ করে চলেছে। এদের অস্ত্রই সমাজে সন্ত্রাসী হামলা, হুমকি-ধমকি, দুর্বৃত্তায়ন, চাঁদাবাজি, অন্যের জায়গা-জমি দখল, এমনকী নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জলে-স্থলে-আকাশে এর বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক প্রয়োগ রয়েছে। কখনো কখনো বৈধ অস্ত্রধারীকেও অবৈধের কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নব্বইয়ের গণআন্দোলনকালে চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি অবৈধ ছিল। কিন্তু নোবেলজয়ী মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের আত্মহত্যার অস্ত্রটি বৈধ ছিল। এটা নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ছিলেন।

অবৈধ বা বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার কার্যক্রম কোনোকালেই যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান, চিরুনি অভিযান, বিশেষ অভিযান চালিয়েও তা সম্ভব হয় না। পত্রিকার ভাষ্য মতে, ২০২২ সালে এক বছরে দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৮৭৯টি। তবে এ কথা সত্য, বাংলাদেশের মতো ভৌগোলিক আয়তনে ক্ষুদ্র ও মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে এটা শতভাগ করা সম্ভব নয়। তাই পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে যা করা হয়, তা কেবল উভয় শ্রেণির অস্ত্রধারীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, সতর্ক করিয়ে রাখা, তার দখলে যে জিনিসটা আছে, কোনো ক্রমেই যেন এর অপপ্রয়োগ না হয়। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। ২. তবে সুশীল বৈধ অস্ত্রধারীরা সব সময়ই তাঁর কাছে থাকা অস্ত্রটা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন থাকেন। একে নিজ দায়িত্বে রাখা, এর প্রতি যত্নবান হওয়া, নবায়নের সময় স্মরণে রাখা, এমনকি নিজের সন্তানদের নাগালের বাইরে রাখা নিয়েও তাঁকে ভাবতে হয়। তিনি এটাকে যত্রতত্র প্রদর্শন না করার মানসিকতাও পোষণ করেন। কিছু আকস্মিক অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা বা ব্যতিক্রম ছাড়া একজন সমাজ সচেতন সুনাগরিকের কর্মের অংশ হিসেবে তিনি তা করে থাকেন। অনেকে কৌতুক করে বলেন, পৃথিবীতে বৈধ অস্ত্র দ্বারা নরহত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা নাকি বেশি। এক্ষেত্রে অস্ত্রের মালিক হন বেশির ভাগই বিত্তবান, সম্পদশালী ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। কারণ অস্ত্র প্রাপ্তির সব সরকারি শর্ত পূরণ করেই তাঁকে তা অর্জন করতে হয়। কাজেই সরকারের ঘোষণাকে তাঁরা আইনমাফিক ও আইনমান্যকারী হুকুম হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। তাঁরাই বিনাবাক্য ব্যয়ে পুলিশস্টেশন বা থানায় গিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে তা জমা দেন। আবার নির্ধারিত সময়ে সশরীরে গিয়ে তা ফেরত নিয়ে আসেন। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ একজন শান্তিপ্রিয় বৈধ অস্ত্রধারী এমনকি একটা বুলেট না খরচ করেই একে আভিজাত্যের প্রতীকের অংশ হিসেবে আগলে রাখেন। এবং যথানিয়মে বেশ মোটা অঙ্কের নবায়ন ফি পরিশোধ করছেন। আবার শেষ বয়সে এসে কেউ কেউ হয় তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারের হাতে হস্তান্তর করেছেন, নতুবা সরকার বাহাদুর বরাবর সমর্পণ করছেন। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্র দেশের ভালো করদাতা, ভালো ব্যবসায়ী বা ভালো কর্মচারীর জন্য সম্মানসূচক প্রণোদনা জাতীয় কত কিছু করছে। একই সঙ্গে আইনমানা বৈধ অস্ত্রধারী এমন নাগরিকদের জন্যও সরকারের একটা দায় থাকা উচিত বলে মনে করি।

৩. দেশে প্রজাতন্ত্রের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে অনেকই শখের বশে বা ঝুঁকি মোকাবিলার প্রশ্নে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে তা সংরক্ষণ করে চলছেন। তাঁরাও শতভাগ সরকারি বিধিমালার আওতায় তা পেয়ে থাকেন। এবং সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে বাসস্থানের নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে জমা করছেন। সচরাচর এর কোনো ব্যত্যয় করা হয় না।

মনে পড়ে, ২০০১ সালের শেষ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং বৈধ অস্ত্র জমাকরণের সরকারি আদেশ হলে আমি আমার .৩২ পিস্তলটি জমা দেওয়ার জন্য মনস্থ করি। আমি তখন খাগড়াছড়ি পার্বত্যজেলার একটা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। এবং একই সঙ্গে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করছি। ব্যক্তিগত অস্ত্রের বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছি। এমন সময় বিষয়টি খাগড়াছড়ি পার্বত্যজেলার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নজরে চলে যায়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে নির্দেশ দিলেন, “আপনার অস্ত্রটি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে সঙ্গেই থাকবে। প্রথমত, এটা সমতল এলাকা নয় বরং পাহাড়ি বিদ্রোহপ্রবণ (insurgent) জনপদ। দ্বিতীয়ত, আসন্নবর্তী নির্বাচনে আপনি নিজেই প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করছেন”। সেদিন বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি আমার অস্ত্রের লাইসেন্সের গায়ে তাঁর এ বক্তব্য ইংরেজিতে লিখে দিলেন এবং বললেন, “জমা না করার সমস্ত দায়িত্ব আমার কাঁধে থাকল”।

আজকাল মাঠ প্রশাসনে এমন দৃঢ়চেতা, আত্মবিশ্বাসী, সাহসী তথা আইন জানা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটেরও হয়তো সংকট আছে।

৪. দেশে অবৈধ অস্ত্র কীভাবে আসে, কারা আনে, কারা ক্রয় করে, কোথায় যায় এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কেননা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যবসার নাম অস্ত্র ব্যবসা। যা নিয়ন্ত্রণ করছে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিকে। তবু দেশি-বিদেশি মিডিয়ার কল্যাণে জানা যায়, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করছে বৈধভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, দেশে মাত্র ১২-১৩ জন ব্যবসায়ী বৈধ পথে অস্ত্র আমদানি করে থাকেন। এদের অনুমোদিত বাংলাদেশ আর্মস ডিলারস অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় চতুর্দিকে স্থল ও জলে সীমান্ত থাকায় অস্ত্রগুলো বিনা বাধায় সহজেই প্রবেশ করতে পারে।  বৈধতার প্রলেপে আসলেও অনেক চড়ামূল্যে এগুলো হাতবদল হতে হতে দুষ্কৃতকারীদের নাগালে পৌঁছে যাচ্ছে। বছরে গড়ে কয়েক শ আগ্নেয়াস্ত্র এ পন্থায় অনুপ্রবেশ করছে। উল্লেখ্য, দেশে বৈধ বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার বলে জানা যায়। অবৈধ অস্ত্রের হিসাব রাখা সম্ভব নয়।

অবৈধ পথে অস্ত্রের প্রবেশ ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নতুন নতুন ডিজিটাল কলা-কৌশল স্থাপন করা হচ্ছে, এন্টি টেররিজম ইউনিটসহ উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।  যদিও এখনো প্রণিধানযোগ্য সাফল্যের দেখা মিলছে না। তবে এর জন্য বিশ্বমানের প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর