ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন। তিনি ছিলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আপন চাচাতো ভাই এবং জামাতা। পুরুষদের মধ্যে হজরত আলী (রা.) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তার সময়ের সেরা বীর। শাসক হিসেবে ন্যায়পরায়ণতার যে নজির তিনি রেখে গেছেন তা এই একাবিংশ শতাব্দীতেও প্রাসঙ্গিক। হজরত আলী (রা.)-এর খুতবাহ, বক্তৃতা, চিঠিপত্রের সংকলন ‘নাহজুল বালাগাহ’। এতে মিসরের গভর্নর হজরত মালিক আশতারকে লেখা খলিফা আলী (রা.) এর চিঠিতে শাসন ক্ষেত্রে ন্যায় ও সুবিচার নিশ্চিত করার যে তাগিদ দেওয়া হয়েছে তা সর্বযুগে অনুকরণীয়।
হজরত আলী (রা.) মালিক আশতারকে লেখা চিঠিতে বলেন, অন্তরে ভাবাবেগ জাগ্রত হলে তখন কোনোরূপ সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ, আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে মানুষের অন্তঃকরণ তাকে পাপের দিকে নিয়ে যায়।... অতএব, তুমি তোমার ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ কর এবং যা তোমার জন্য বৈধ নয় সে কাজ থেকে তোমার অন্তরকে বিরত রাখ। কারণ, অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে অন্তর যা পছন্দ করে ও যা অপছন্দ করে তাকে এ দুয়ের মাঝখানে ধরে রাখা। নাহজুল বালাগার বক্তব্যে আমরা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পার্থিব সমস্যাবলির বাস্তব সমাধান লাভ করি। তেমনি এতে আমরা সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঐক্য ও নিরাপত্তা অর্জনের পথ খুঁজে পাই। যে লক্ষ্যে হজরত আলী (রা.) তাঁর গভর্নরকে লোকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সুবিচার অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তাঁর চিঠিতে বলেন, “তোমার অন্তরকে তোমার অধীন জনগণের প্রতি ক্ষমা এবং তাদের প্রতি স্নেহ ও দয়া প্রদর্শনে অভ্যস্ত করে তোল। তুমি তাদের ওপর হিংস্র পশুদের ন্যায় চড়াও হয়ো না যারা মনে করে যে, তাদের খেয়ে ফেলাই যথেষ্ট। কারণ, তারা (তোমার অধীন জনগণ) দুই ধরনের : হয় তোমার দীনি ভাই, নয়তো সৃষ্টি হিসেবে তোমারই মতো। তারা বিচ্যুত হবে এবং ভুলের শিকার হবে। তারা ভুল কাজ করতে পারে, তা ইচ্ছা করেই হোক বা উদাসীনতার কারণেই হোক। অতএব, তুমি ঠিক সেভাবেই তাদের দিকে ক্ষমার হাত প্রসারিত করে দাও যেভাবে তুমি পছন্দ কর যে, আল্লাহ তোমার প্রতি ক্ষমা বিস্তার করে দিন। কারণ, তুমি তাদের ওপরে স্থান লাভ করেছ এবং তোমার অধিনায়ক (আলী) তোমার ওপরে, আর যে তোমাকে নিয়োগ করেছে তার ওপরে আছেন আল্লাহ। তিনি (আল্লাহ) চেয়েছেন যে, তুমি তাদের বিষয়াদি পরিচালনা করবে এবং তিনি তাদের মাধ্যমে তোমাকে পরীক্ষা করছেন।”
হজরত আলী (রা.) সমাজে সুবিচারের বাস্তব রূপায়ণে বলেন : ‘ক্ষমা করার কারণে অনুতপ্ত হয়ো না এবং শাস্তি দিতে পেরে গর্বিত হয়ো না। ক্রোধের সময় দ্রুত পদক্ষেপ নিও না। এ কথা বলো না যে, ‘আমাকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে; অতএব, আমি যখন আদেশ দেব তখন অবশ্যই তা পালিত হতে হবে।’ কারণ, তা অন্তরে বিভ্রান্তি ও দীনে দুর্বলতা সৃষ্টি করে এবং তা ব্যক্তিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। হজরত আলী (রা.) তাঁর গভর্নরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন : ‘তোমার জন্য সর্বাধিক বাঞ্ছনীয় হওয়া উচিত তাই যা সর্বাধিক ন্যায়ানুগ, যা সর্বাধিক মাত্রায় সর্বজনীন সুবিচারপূর্ণ এবং তোমার অধীনদের পছন্দের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাধিক বোধগম্য। হজরত আলী (রা.)-এর উপরিউক্ত বক্তব্যে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সুবিচার বিস্তারের মর্মবাণী ও মানবিক আবেদন নিহিত রয়েছে তা অনুধাবন করা যে কারও পক্ষেই সম্ভব। সম্ভবত সব পার্থিব শাসনব্যবস্থা পক্ষপাতিত্বের দোষে আক্রান্ত। আলী (রা.) এ ধরনের শাসন ব্যবস্থার শাসকদেরকে জালেম এবং এ কারণে নৈতিকতার মূল্যবোধ পদদলিতকারী ও ও মানবিকতার উদ্দেশ্য নস্যাৎকারী শোষক হিসেবে অভিহিত করেন। অবৈধ ও বেআইনি কার্যকলাপ এবং গোষ্ঠী বিশেষের প্রতি পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে যেভাবে জুলুম করা হয় তিনি তার বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কারণ, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সুবিচার বিস্তারের ধারণা হারিয়ে যায়। কেবল সেই সব লোকই এ ধরনের জুলুমমূলক পদ্ধতি পরিহার করে চলেন যারা আল্লাহকে ভয় করেন এবং তাঁরা সমাজকে সেই দিকে পরিচালিত করেন। হজরত আলী (রা.) যে জন্য মালিক আশতারকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা যেন সমাজকে সকলের, বিশেষ করে দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকদের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যাভিসারী করে গড়ে তোলেন। হজরত আলী (রা.) বলেন : যারা মুসলমানদের ধর্মীয় শক্তির স্তম্ভ এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাস্বরূপ তারা হচ্ছে সাধারণ জনগণ। অতএব, তোমার উচিত তাদের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া ও তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা। হজরত আলী (রা.) এখানে গভর্নর মালিক আশতারকে যে পথনির্দেশ দিয়েছেন এটাই হলো আজকের দিনে প্রকৃত গণমুখী শাসনব্যবস্থা। অত্যন্ত চমৎকারভাবে ইসলামের চতুর্থ খলিফা জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে চেষ্টা-সাধনা চালানো ও তাদের দিকে মনোযোগী থাকার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন শাসক বা প্রশাসকদের পরামর্শদাতা বা উপদেষ্টাদের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি তুলে ধরেছেন। যা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। কারণ, তিনি সাধারণ জনগণকে ধর্মের স্তম্ভ, রাষ্ট্রের শক্তি ও শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা প্রাচীর বলে গণ্য করেছেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যা আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক এবং রাষ্ট্রনেতাদের জন্য অনুকরণীয়।
♦ লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        