বর্তমান বিশ্বে পৃথিবীর যে কোনো দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা নির্দেশ করে সে দেশের রিজার্ভ তথা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা মজুত পরিস্থিতির ওপর। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের এই রিজার্ভ আদ্যাক্ষর আর বা ‘র’ দিয়ে শুরু কয়েকটি শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই তিনটি আর এর প্রথমটি হলো রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা। দ্বিতীয়টি, রেডিমেড গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাক রপ্তানিজনিত আয়। এক্ষেত্রে অনেকে আবার ‘র’ (Raw) বা কাঁচামাল রপ্তানিজনিত আয়কেও এক্ষেত্রে যুক্ত করেন, যার মধ্যে রয়েছে কাঁচা চামড়া, কাঁচা পাট, কাঁচা হিমাহিত মাছ, কাঁচা বা টাটকা শাকসবজি, ফল, কাঁচা তথ্য প্রযুক্তিজনিত উৎপাদন ইত্যাদি।
রিজার্ভের আরেকটি স্তম্ভ রিইনভার্সমেন্ট, যা আসে মূলত জাতিসংঘ থেকে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমসহ নানাবিধ দাপ্তরিক ও সেবামূলক কাজে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা তথা সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অংশ নিয়ে থাকেন। এমন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য জাতিসংঘ দুভাবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমত, অস্ত্র, সরঞ্জাম, গাড়ি, সাঁজোয়া যান, বেতার যন্ত্র, সৈন্যদের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সবকিছু নিয়ে অংশগ্রহণ; যা জাতিসংঘের ভাষায় ‘ওয়েট লিজ’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয়ত, কেবল মানবসম্পদ বা সৈন্য প্রেরণ, যাদের মিশন এলাকায় কর্তব্য পালন বা জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগানের দায়িত্ব জাতিসংঘের। উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিটি মানুষের বা ব্যক্তির পদমর্যাদা ও দায়িত্বপূর্ণ এলাকার ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থা তথা ঝুঁকি বিবেচনায় বেতন দেওয়া হয় মার্কিন ডলারে। সৈন্যসহ সামরিক দল বা কনটেন্টের সদস্য হিসেবে যাওয়া ব্যক্তির বিপরীতে নির্ধারিত অঙ্কের ডলার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে আসে সরকারের কাছে তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে। পরবর্তীতে সরকার এই ডলারের সমপরিমাণ টাকার বড় অংশ পদমর্যাদা অনুসারে প্রতিটি বাহিনী সদর দপ্তরের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যাংক হিসেবে পাঠিয়ে দেয়।
অন্যদিকে যদি অন্য সৈন্যরা ওয়েট লিজে যায়, অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য সবকিছু নিয়ে যায়, তবে প্রতিটি অস্ত্র, গাড়ি, এমনকি রান্নায় ব্যবহৃত প্রতিটি হাঁড়ি-পাতিল বা ব্যক্তির ব্যবহৃত পণ্যের বিপরীতেও জাতিসংঘ থেকে ডলার ফেরত পায় যা রিইনভার্সমেন্ট নামে পরিচিত। ২৪/৭ আন্দোলনের তথা ২৪ সালের সপ্তম মাসের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও পরবর্তী রাজনৈতিক ও সরকারি তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মানুষের অধিকাংশ ও বৃহত্তর প্রবাসীরা রেমিট্যান্স শাটডাউন বা রেমিট্যান্স বৈধ পথে পাঠানোর বন্ধের ডাক দিয়েছিল। এই ডাক এমন সময় দেওয়া হলো, যখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রচ- ঝুঁকির মধ্যে আছে এবং বাংলাদেশ সম্প্রতি চীন থেকে রিজার্ভের ঘাটতি পূরণের জন্য কাক্সিক্ষত ঋণ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশ-বিদেশ থেকে সমানে আহ্বান জানানো হয়েছিল যেন অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখেন প্রবাসীরা। এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে বলা হয়েছিল, একমাত্র ডলার সংকট হলেই দেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এমনকি জ্বালানি তেল কিংবা শিশুখাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ হবে আর তখনই সরকার নতজানু হবে কিংবা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে। ইতোমধ্যে বিশেষত গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে তা ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যার কারণে না দেশের বিক্ষোভকারী ও প্রবাসীদের আন্দোলনের কারণে তা স্পষ্ট নয়। রেডিমেড গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ করে নতুন ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে ভাটা পড়ার তথ্যও জানিয়েছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা। জাহাজীকরণে বিলম্ব, সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়া এবং ভূরাজনীতি সামাল দিতে ব্যর্থতার কারণে তৈরি পোশাকের অন্যতম আমদানিকারক আমেরিকা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশের দিকে ঝুঁকছে বলে মন্তব্য করেছে দেশের একটি ইংরেজি দৈনিক। এ ছাড়াও রাস্তায় সন্ত্রাস ও বন্দরে সুস্থ পরিবেশ না থাকলে রপ্তানি ধ্বংস অনিবার্য। র (raw) মেটেরিয়াল বা চামড়া, পাট, মাছ, সবজি, ফল, প্রাথমিক তথ্য প্রযুক্তিও রপ্তানি বন্ধ হয় এমন পরিস্থিতিতে। অন্যদিকে আমদানি হ্রাসের খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে শঙ্কার বিষয় হলো এই আমদানি হ্রাস পাওয়া পণ্যের মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামালও আছে, যা ভবিষ্যতে রপ্তানি হ্রাস ও আমদানি বৃদ্ধির ইঙ্গিত বহনকরে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী নামে। সে সময় জাতিসংঘের সংকেত ইউএন লেখা সাদা রঙের সাঁজোয়া যান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার আন্দোলনের জাতিসংঘকে উদ্বেগে ফেলেছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনী থেকে র্যাবের যাওয়া সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন মর্মে অভিযোগ তুলে তাদেরসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বৈদেশিক শান্তিরক্ষা মিশনে প্রেরণ স্থগিতের একটি দাবি উঠেছিল একটি মহল থেকে। সেই দাবিতে ঘি ঢালতে প্রতি মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে এবং কোনো কোনো সদস্যের মুখের ভাষাসহ চিত্র কিংবা দূর থেকে ধারণ করা চিত্র শব্দ সংযোজন করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে জাতিসংঘ মিশন নিয়েও শঙ্কায় কাটছে কারও কারও রাতদিন। কারণ এতে দ্রুতই কমবে দেশের রিজার্ভ।অতি সম্প্রতি দেশের একটি গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক তথাকথিত আয়নাঘর নামের বন্দিশালায় বিনাবিচারে দীর্ঘ আট থেকে ১০ বছর একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ও একজন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আইনজীবীকে আটক অবস্থা থেকে মুক্ত করা হয়েছে। তারা যে কয়দিন এই গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন, তা পরিচালিত হয়েছে সেনা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। সুতরাং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। ভবিষ্যতে এ বিষয়টি বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা না করলে বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘে নিয়োগের বিষয়টি আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
তবে আশার কথা সশস্ত্র বাহিনী কোথাও বিক্ষোভ দমনে শক্তিপ্রয়োগ করেনি। জাতিসংঘের সংকেত সংবলিত গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহার ছিল অনিচ্ছাকৃত ভুল। দেশে ফেরার পর গাড়ি ও হেলিকপ্টারের ইউএন লেখা মুছে ফেলার আগেই সেগুলো ব্যবহার করার বিপত্তি ঘটেছে। সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনও ঘটেছে ইতোমধ্যে। আর আদ্যাক্ষর দিয়ে লেখা আরেকটি শব্দ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে এই দেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে থাকে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতায় ঘাটতি দেখা দিলে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। সার্বিক বিচারে বলা যায় কাঁপন ধরেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রতিটি স্তম্ভেই। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আর যোগ্য ব্যক্তিদের ওপর তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে আগামীর রিজার্ভ চিত্র তথা আগামী বাংলাদেশের অবয়ব।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]