অতি বৃষ্টি এবং ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পানির ঢলে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে আকস্মিক তীব্র বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। ক্রমেই বন্যা ছড়িয়ে পড়ে দেশের ১১ জেলায়। বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। এখনো লাখো মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা বলেন, ১৯৮৮ সালের পর এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়নি আগে কখনো।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১১টি জেলার ৭৩টি উপজেলার ৫৪৫টি ইউনিয়ন-পৌরসভা বন্যায় প্লাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বন্যায় ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন ২ জন। এ সংখ্যাটি বাড়ার আশঙ্কা আছে।
বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সাধারণ শিক্ষার্থী, জনসাধারণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও অন্য স্বেচ্ছাসেবকরা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি জেলা ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী। চ্যানেল আইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি দল বন্যাদুর্গত এলাকার প্রতি মুহূর্তের খবরাখবর পাঠাচ্ছেন। তারা জানিয়েছেন কুমিল্লা জেলার ১৪টি উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলায় ৯ লাখ ৫১ হাজার ১০৯ জন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। আর আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেছিলেন ৬৬ হাজার ৯৬৬ জন। নোয়াখালীর আট উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১ হাজার ১৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। এবারের বন্যায় ফেনীতে ৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেনী শহরসহ পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়াতে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে সদর উপজেলা, সোনাগাজী ও দাগনভূঞাতে বন্যা পরিস্থিতি এখনো অবনতির দিকেই আছে।
বাংলাদেশের মানুষ সম্মিলিতভাবে বন্যা মোকাবিলা করছে। বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের কৃষি, তথা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা। আকস্মিক তীব্র বন্যায় ১১ জেলায় ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার জেলায় প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ফেনীর প্রায় শতভাগ জমির ফসলই পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে আমন বীজতলা, আমন আবাদ, বোনা আমন, আউশ আবাদ, শাকসবজি, পান, ফলবাগান, আদা, হলুদ ও আখ। এই অঞ্চলের চাষ হয়েছে এমন ফসলি জমির পরিমাণ ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩৪৯ হেক্টর। এর মধ্যে গত ১৬ থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত বৃষ্টি ও বন্যায় মোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫২ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪৪১ হেক্টর জমির আমন বীজতলা, ১ লাখ ৩০ হাজার ৫৪৪ হেক্টরের আমন আবাদ, ৩ হাজার ২৪০ হেক্টরের বোনা আমন, ২৫ হাজার ৮৯১ হেক্টর জমির আউশ আবাদ, ৭ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির শাকসবজি, ১১ হাজার ৭৩৯ হেক্টরের ফলবাগান, ৬২ হেক্টরের আদা, ১৫৬ হেক্টরের হলুদ, ৪২০ হেক্টর জমির পান ও ৩১৪ হেক্টর জমির আখের ক্ষতি হয়েছে।
এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বন্যা-পরবর্তী সময়ের কৃষি নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ করতে হবে। কৃষকের জন্য কৃষি ঋণের বিশেষ প্যাকেজ করা যেতে পারে। আমাদের কৃষক যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছেন তাদের এই মুহূর্তে ঋণের কিস্তি দেওয়া সম্ভব না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। যেসব অঞ্চলের পানি নামতে সময় নেবে, সেসব অঞ্চলে ভাসমান বা দাকোপ বীজতলা তৈরির কৌশলগত প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদনে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যা-পরবর্তী আমন ফসল ছাড়াও রবিশস্যের চাষ শুরু হওয়ার কথা। ফলে এ সময়ে কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত বীজ ও সার থাকা জরুরি। প্রশ্ন হচ্ছে, পর্যাপ্ত সার কি আমাদের মজুদ আছে? আর মাস দুয়েকের মাঝে শুরু হচ্ছে বোরো ও রবি মৌসুম। দেশে সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী মৌসুমটিতে সারসহ চাষাবাদের প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদাও থাকে সবচেয়ে বেশি। দেশে মোট রাসায়নিক সারের ৭০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহৃত হয় শুধু বোরো ও রবি মৌসুমে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন। সারের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সরকারি গুদামগুলোয় সারের মজুত আছে প্রায় ১৮ লাখ টন।
আমি বিশ্বাস করি, সরকার ইতোমধ্যে সার ও বীজ কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। আমার মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সার নিয়ে ডিলার ও কৃষকের মাঝে অনেক ক্ষেত্রে দূরত্ব আছে। তাই কৃষক যেন সহজে সার-বীজসহ কৃষি উপকরণ পেতে পারে সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের খামারিরা। লাখ লাখ টাকার পুকুরের মাছ ও খামারের গবাদি প্রাণী হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেকেই। চলমান বন্যায় প্রাণিসম্পদ- পোলট্রি, পশুখাদ্য, মাছ এবং অবকাঠামোর প্রায় ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন মৎস্য খামারিরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, জলাধার ও খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। এ ছাড়াও প্রায় ৩৭৫ কোটি মাছের পোনা ও পোস্ট লার্ভা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু খাতে এখন পর্যন্ত ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। আকস্মিক বন্যার পানিতে অনেক গবাদিপশু ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক খামারি। বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদায়। প্রাণিসম্পদ খাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খামারিদের জন্য সত্যি খুব কঠিন। তাই তাদের ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান একান্তই দরকার।
১. মৎস্যচাষিদের জন্য বিশেষ প্যাকেজে বিনাসুদে বা স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
২. মাছের রেণু ও মাছের খাবার ত্রাণ সহযোগিতা হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
৩. বন্যা-পরবর্তী গরু-ছাগলের রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করতে বিশেষ বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা যেতে পারে।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত খামারগুলোতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৫. ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের দলভিত্তিক উৎপাদনের আওতায় আনা যেতে পারে এবং তাদের খামারে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিশেষ দামে শহরের সচ্ছল নাগরিকদের কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবিলা করেছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। বৃহত্তর স্বার্থে আগামীর দিনগুলোতেও আমাদের এক থাকতে হবে। থাকতে হবে কৃষি ও কৃষকের পাশে। যে ক্ষতিটুকু হয়ে গেছে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা, ছাদ এবং পতিত জায়গাটুকু হয়ে উঠুক কৃষির অঙ্গন। যার যার নিজস্ব জায়গা থেকে ফল-ফসল ফলানোর সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গড়তে হবে ক্ষুধামুক্ত সাম্যের বাংলাদেশ।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব