ঘোড়ায় টানা গাড়িতে মালবোঝাই করে বিক্রি করার জন্য ইরানি বণিকরা দূর-দূরান্তে যেতেন। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ গাড়ির বহর আবার ইরানে ফিরে আসতে পাঁচ-সাত মাস লেগে যেত। ফিরতি গাড়িতে থাকত বিদেশি পণ্য। তাঁদের গাড়ির এ বহরকে বলা হতো ‘কারওয়াঁ’। (ইংরেজি ‘ক্যারাভান’ শব্দটির উৎপত্তি কারওয়াঁ থেকেই) মুঘল আমলে এ ধরনের কারওয়াঁ বহুবার ঢাকা শহরে যাতায়াত করেছে। গাড়িগুলো দোকান হয়ে যেখানে কাজ করেছে সেই জায়গাটিই আজকের কারওয়ান বাজার। সেকালের ইরানি বণিকরা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বুঝে বিপণন করতেন। কথিত আছে এরকম এক বণিক কারওয়াঁ নিয়ে ভারতের দিকে বাণিজ্য যাত্রা করছিলেন। সঙ্গে রয়েছে তাঁর এক কিশোর ছেলে। পথিমধ্যে একটি বাজারে বিকিকিনির সময় ছেলেটি আম কিনে দেওয়ার আবদার করে। বণিক গেলেন আম কিনতে। তিনি দেখেন প্রতি কুড়ি আম দশ মুদ্রা। ছেলেকে বণিক বললেন, ‘বাপরে! এত চড়া দাম! নাহ এই বাজার থেকে কিনছি না। সামনে আরও অনেক বাজার পাব। তখন দেখা যাবে।’
সামনে যে সাতটি বাজার পেয়েছিলেন সেগুলোয়ও আমের দর চড়া। আম আর কেনা হয় না। ফিরতি পথে বাজারে বাজারে কেনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পাঁচটি বাজারের কোথাও আম নেই। শেষতক কারওয়াঁ এসে পৌঁছে গেল সেই প্রথম বাজারে। বণিক ছেলেকে বলেন, ‘ওই যে দেখ আমের দোকান। চল তোমায় কিনে দিই।’ দোকানির কাছে বণিক জানতে চান, দর কত। দোকানি জানায়, আমের কুড়ি চল্লিশ টাকা। বণিক বলেন, ‘দাও পাঁচ কুড়ি।’ বাপের কাণ্ড দেখে ছেলে চমকিত। দশ টাকা দর দেখে যিনি এক কুড়ি আমও কিনলেন না, সেই তিনি এখন দু’শ টাকায় পাঁচ কুড়ি আম খরিদ করছেন!
‘তুমি কৃপণতা করে আগে কিনলে না।’ ছেলে বলল বাবাকে, ‘এখন চার গুণ দরে কিনে ফেললে হাসতে হাসতে। এমন করলে কেন বাবা?’
মহামতি ভলতেয়ার বলে গেছেন, ‘উত্তর শুনে নয়, প্রশ্ন দেখে মানুষকে যাচাই কর।’ ছেলেকে যাচাই করে বণিক বুঝলেন, চড়া দামে অবলীলায় আম্রক্রয় পুত্রের কাছে বিরাট একটা রহস্য হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি ছেলেকে জানান, হিন্দুস্তান রওনা দেওয়ার সময় পথে যে মাল বেচেছেন তাতে মুনাফা তেমন হয়নি। সব মাল বেচার পর হিসাব করে দেখলেন, অনেক মুনাফা হয়েছে। এতে ক্রয়ক্ষমতা বেশ বেড়ে গেছে। তাই, ফিরতে পথে বেশি দরে আম কেনায় কোনো সমস্যা হয়নি।
২. সাংবাদিক সাহিত্যিক আফলাতুন (মৃত্যু : ১৪ মে, ২০০৬) বলতেন, পারচেজিং পাওয়ার বৃদ্ধির গতি মাঝে-মধ্যে মন্থর হওয়া সমাজের জন্য মঙ্গলকর। নইলে পাওয়া বাড়বার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে চাওয়া। খাই খাই আরও খাই বিমার তোমারে চুষতে চুষতে ফোকলা করে দেবে। চাওয়া আর পাওয়া আর খাই খাই হয়ে যাবে ফাঁস। করবে তোমার সর্বনাশ।
সে আবার কী? বৈকালিক আড্ডায় আমরা প্রশ্ন করি আফলাতুন দাদুকে। তিনি তাঁর এলাকা সন্দ্বীপে বাড়ি, বাস করে ঢাকায় এরকম এক ব্যক্তির সর্বনাশ হওয়ার বৃত্তান্ত দিলেন। লোকটার নাম মনতাজ আলী ফকির। সরকারি দপ্তরের নিম্নবর্গীয় অফিসার মনতাজের পদায়ন এমন জায়গায় হয়েছিল যে, বাতাসের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে যাবতীয় ঘুষ নাক দিয়ে ঢুকে পাকস্থলীতে দাখিল হয়।
আফলাতুন দাদুর ভাষায়, ব্যাডায় চব্বিশ ঘণ্টা ননস্টপ হারাম খায়। ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে নালিশ দিলে তাকে দূরতম অঞ্চলে বদলি করা হয়।
নতুন জায়গায় উচ্চ ফলনশীল চাষাবাদের সুযোগ পেয়ে ট্রিপল স্পিডে ঘুষ খেতে থাকে মনতাজ আলী ফকির। হারামির টাকায় তার তিনটি বাড়ি হয়ে গেল প্রধান তিন শহরে। প্রতিটি বাড়িই চার তলা। বউয়ের সংখ্যাও ৪-এ উঠল। রক্ষিতা পোষণের নেশা? হ্যাঁ, সেটাও চলমান রেখেছে সে। তবু তার খাই খাই যায় না। করাত কল, আটা-ময়দা কল, ইটখোলা, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল তৈরির কারখানা, হাঁস-মুরগি আর মাছের খামার সবই হয়েছে। সহায়-সম্পত্তি খালি বাড়ছে আর বাড়ছে। এমন সময় আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান নামক এক সেনাপতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের দণ্ডধর রূপে আবির্ভূত হন।
দুনিয়ায় তো ভালো কাজের কত রকম সুযোগ! সেসব সুযোগের দিকে মনোযোগ না দিলে জেনারেল ইয়াহিয়া কেন শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন তা একমাত্র আল্লাহ গাফুরুর রাহিমই জানেন। মনতাজের চাকরি গেল। আয়ের সঙ্গে মিলমিশ খায় না কিসিমের সম্পত্তি অর্জনের দায়ে হাফডজন মামলার আসামি হয় মনতাজ। উকিল ব্যারিস্টারের খাই মেটাতে গিয়ে মনতাজ আলী ফকির শাব্দিক অর্থেই ‘ফকির’ হতে শুরু করে।
ইয়াহিয়া আর মনতাজ স্বভাবগত একই ঘরানার ইনসান। আফলাতুন বুলেটিন থেকে আমরা জানতে পারলাম, দুজনেরই প্রশ্ন শুনে তাদের মতলব আঁচ করা যায়। সুবেশ প্রিয়দর্শিনী কাউকে দেখলে মনতাজ প্রশ্ন করত, বিয়া অইছেনি? ইয়াহিয়া কী জানতে চাইতেন? তিনি নাকি বলতেন, ‘শাদি হুয়াকে নেহি?’
৩. রাজধানীর মতিঝিল বাণিজ্য এলাকায় যে অফিসে একদা কাজ করতাম, সেখানে ঘটনাক্রমে বেতন অনিয়মিত হয়ে গেল। শৃঙ্খলা বিপন্ন হয়ে পড়লে কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে প্রতিদিন বেতন দেওয়ার সিস্টেম চালু করে। ধরা যাক, রবিবার বেতন দেওয়া হবে শুনে জড়ো হলো বেশ কয়েকজন। ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর ঘোষণা- ‘যাদের বেতন পঁয়ত্রিশ হাজার শুধু তারা আজ পাবেন।’ ঠিক আছে। তা-ই দাও।
‘রেডি হোন। এশার নামাজের পর থেকে দেওয়া শুরু হবে।’ ঘোষণা দেন ম্যানেজার। পঁয়ত্রিশ হাজার বেতনধারী ১০ জন। চারজনকে দেওয়ার পর ঘোষণা, ‘তহবিল অকুলান। প্লিজ আগামীকাল আসুন।’
বকেয়া বেতন আগামীকাল পাওয়া যাবে- এই আশায় দিন যায় দিন আসে, বেতনের দিন আসে না। তবু কালের চাকা ঘোরে। আমরাও ঘুরি। এভাবে দেখতে দেখতে ঈদুল ফিতরের দিন ঘনায়। ‘শবেকদরের আগের দিন বোনাস ও বেতন হবে’ সংবাদ পেয়ে ওইদিন ইফতারের পর থেকে অপেক্ষা শুরু। রাত ১০টায়ও ইতিবাচক খবর আসে না।
প্রবীণ সহকর্মী আবদুল লতিফ ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। অপেক্ষার ধকল তাঁকেও তপ্ত করে ফেলেছিল। তিনি বলেন, পাবো পাবো করে এই অপেক্ষার মতো যন্ত্রণা আর হয় নারে ভাই। চিৎকার করে আমার কী বলতে ইচ্ছে করছে জানো?’ তাঁর প্রশ্নের ধরনে আমরা বুঝলাম, তাঁর ধৈর্যের দেয়ালে চিড় ধরেছে। মুখে বললাম, বলে ফেলুন না! তিনি বলেন, ‘বলতে ইচ্ছে করে ‘আল ইন্তেজারু আশহাদু মিনাল মওতে’ (অপেক্ষা মৃত্যুর চাইতেও ভয়ংকর)।
৪. প্রশ্ন শুনে মানুষকে বোঝার চেষ্টা করছি অনেক দিন। সঠিক বুঝতে পারলে আনন্দ হয়। শেখাও হয়। প্রশ্নের উত্তর শুনেও অনেক কিছু শেখা যায়। প্রশ্ন দেখে কী শিখেছি, তা বলার আগে বলি, প্রশ্ন শুনে কী রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম।
প্রশ্ন করেছিল আমার ভাইজি নিশাত জেরিন শ্রুতি। অকালে তার প্রয়াণ ঘটেছে (২০২৩ সালের ২০ এপ্রিল)।
শ্রুতি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সন্ধ্যায় এক টিউটর এসে তাকে পড়াতো। ঢাকা থেকে যখনই বাড়ি যেতাম সে কাকা কাকা করে সারাক্ষণ আমার কাছাকাছি থাকত। একবার বিকালে বাড়ি থেকে বেরুবো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। শ্রুতি বেরুবে কাকার সঙ্গে। জামাকাপড় পরে সে রেডি। ওদিকে টিউটর আসবে একটু পরেই। ওকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বললাম, ‘গোফরানদের বাড়ির পাশে যে ঝোপ সেখানে বাঘ থাকে। ওই পথ দিয়ে যেতে তোমাকে দেখলে বাঘেতে খেয়ে ফেলবে।’
টেলিভিশনে শ্রুতি দেখেছে বাঘ কীভাবে হরিণ শিকার করে। তাই সে দমে গেল। কাকার সঙ্গে যাবে না। ঘরে ঢুকে জুতা খুলতে খুলতে শ্রুতি কী ভেবে দ্রুত এসে আমায় বলে, ‘তুমিও তো ওই পথে যাবে। বাঘ তোমাকে খাবে না? বাঘ তোমারে ডরায়?’
উত্তর শুনে শেখা : উত্তর শুনে শিখেছি, যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অসম্ভব সে প্রশ্নটির প্রশংসা করতে হয়। এরশাদীয় জমানার তথ্যমন্ত্রী ড. মিজানুর রহমান শেলী দৈনিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন। স্বৈরাচারী শাসনবিরোধী আন্দোলনকারীরা ময়মনসিংহে এক সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা করার পর দিন মতবিনিময়। সভায় মন্ত্রী পরামর্শ দেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানবিষয়ক নেতিবাচক কোনো ‘সংবাদ এলে তার সত্যতা জেনে নেবেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসাররা সব সময় আপনাদের সেবায় প্রস্তুত।’
এক বার্তা সম্পাদক বলেন, মাননীয় তথ্যমন্ত্রী। আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলে অফিসাররা আমাদের সেবা দেওয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা রেডি থাকেন। অন্য সময় আমরা চব্বিশ ঘণ্টা চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কানেকটেড হতে পারি না। এমন হয় কেন?
জবাবে ড. শেলী বলেন, ‘ইটস আ নাইস কোশ্চেন।’ পরক্ষণেই বার্তা সম্পাদকদের মনোযোগ ঘোরানোর কৌশল নিলেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি তাঁর পেছনে দাঁড়ানো উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তাকে (ইনি পরে প্রধান তথ্য কর্মকর্তা পদে উন্নীত হয়েছিলেন) বললেন, ‘কী হারুন সাহেব (হারুন অর রশিদ : মৃত্যু ৩ এপ্রিল ২০২১) চা-নাশতার কী করলেন। আমাদের খাওয়ান প্লিজ।’
লেখক : সাংবাদিক