ইসলাম। মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার একমাত্র ঠিকানা। ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনাই পুরো মানবতার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। ইসলামের সৌন্দর্যময় নির্দেশনাবলির মাঝে অনন্য ‘বিনয়-নম্রতা’। একজন মানুষের উত্তম যত গুণ আছে সেগুলোর মাঝে বিনয় নম্রতা অন্যতম। ব্যক্তিজীবনে যে যত বিনয়ী ও নম্র, সে তত বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। বিনয়গুণ দিয়ে অন্যের হৃদয়ে বপন করা যায় ভালোবাসার বীজ। আর যারা আল্লাহর হুকুম পালন করে তারা শ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র এবং তাদের বন্ধু আল্লাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রসুল (সা.) ও মুমিনগণ যারা বিনত হয়ে সালাত কায়েম করে ও জাকাত প্রদান করে।’ (আল কোরআন, সুরা মায়েদা-৫৫)। বিনয় ও নম্রতা ইসলামি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মানবচরিত্রের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের নিদর্শন এ বিনয় নম্রতা। ইসলাম মানুষের কল্যাণার্থে যেসব সচ্চরিত্রের সন্ধান দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বিনয় ও নম্রতা উল্লেখযোগ্য।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারাই দয়াময়ের প্রিয় বান্দা, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ (আল কোরআন, সুরা ফুরকান-৬৩)। বিনয় ও নম্রতা মানুষের মহৎ গুণ। যা মানুষকে অপরাপর সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। পৃথিবীর সব মহামানবের মধ্যেই এ গুণটি বিরাজমান। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন নিতান্ত বিনয়ী। তাঁর বিনয় ও নম্রতার দিগদিগন্ত সর্বোৎকৃষ্ট, অনুপম। আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ, মুক্তির সোপান।
বিনয় অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, ‘যারা তোমার অনুসরণ করে সেসব বিশ্বাসীর প্রতি বিনয়ী হও।’ (সুরা আশ-শুআরা-২১৫)।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসুল এবং তাঁর সঙ্গে আছেন, তাঁরা কাফিরদের প্রতি বজ্রকঠোর। আর নিজেরা নিজেদের প্রতি বড়ই করুণাশীল।’ ( সুরা আল-ফাতাহ-২৯)।
ভালো কথা ও উত্তম আচরণ তথা বিনয় নম্রতার মাধ্যমে শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না। অতএব মন্দকে উত্তম (ব্যবহার) দ্বারা প্রতিহত কর। ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে, (অচিরেই) সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে।’ (সুরা হা-মীম সাজদাহ-৩৪)।
সব সৌন্দর্যের ধারকবাহক মানবৈতিহাসের শ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ মানুষ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য সৌন্দর্যের মাঝে শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য ছিল তাঁর বিনয় নম্রতা। সিরাতের গ্রন্থাবলির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে নবীজির বিনয় নম্রতার চিত্তাকর্ষক সেসব গল্প। এই যে কী অসাধারণ বিনয়ের দৃপ্ত প্রতিচ্ছবি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
একদিন এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর দরবারে হাজির হলে তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার! রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেন লোকটি। তার কম্পনরত অবস্থা দেখে তিনি নবীজিকে বলে উঠলেন, ‘তোমাকে স্থির কর। স্বাভাবিক হও। আমি কোনো অত্যাচারী কিংবা জোরদখলকারী নই, কেবল একজন মায়ের সন্তান; মক্কা নগরীতে শুষ্ক গোশত ভক্ষণকারী মাত্র।’ করুণার বাণী শুনে স্বাভাবিক হলেন লোকটি। আর বললেন প্রয়োজনের কথা। এরপর দাঁড়িয়ে লোকদের উদ্দেশে প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, হে লোক সকল! আমি প্রত্যাদিষ্ট হলাম যে তোমরা বিনয় প্রকাশ কর। এমনভাবে বিনয় প্রকাশ কর যাতে একে অপরের মাঝে অহমিকা প্রকাশ না পায়। তোমরা আল্লাহর বান্দা এবং পরস্পরে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হও (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬৪, সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নং-৪৮৯৫)। বোঝা যায় তার ভীতিবিহ্বল দয়া অনুগ্রহ ও স্নেহ ভালোবাসায় রূপায়িত হয়ে গেল। কারণ মুমিনের প্রতি তিনি দয়াবান। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন যে ‘আমি রাজাধিরাজ নই।’ রাজা হওয়ার্থে রাজত্ব দখল নিতান্ত প্রয়োজন। জোরদখলও দরকার। অথচ এসব অমূলকতা ঊর্ধ্বে উঠে ঘোষিত হয়েছে তাঁর (সা.) অমীয় বাণী, ‘আমি কেবল এক রমণীসন্তান; যে রোদে শুকানো গোশত চর্বণ করে ভক্ষণ করে।’ (সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নং-৪৮৪৭)। বাড়ির খাদেম বা কাজের লোকের প্রতি আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিনয়ী ও নম্র ছিলেন। হজরত আনাস (রা.) ছিলেন নবীজির অন্যতম খাদেম। আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি ১০ বছর রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমত করেছি। তিনি কখনো আমার জন্য ‘উহ’ শব্দ বলেননি। কোনো কাজ করে বসলে তিনি এ কথা বলেননি যে, ‘তুমি এ কাজ কেন করলে?’ এবং কোনো কাজ না করলে তিনি বলেননি যে, ‘তুমি কেন করলে না?’ (বুখারি শরিফ, হাদিস নং৬০৩৮; মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-৬১৫১)।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর