বিশ্বজুড়ে বিদ্যুৎশক্তির চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই চাহিদা দিনের পর দিন বাড়ছে। শক্তির এই ক্রমবর্ধমান দিককে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কীভাবে বর্তমান শক্তির অভাব পূরণ ও ভবিষ্যতে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার জোগান বাড়ানো যাবে, তা চিন্তাভাবনা করা দরকার। চিরাচরিত যে শক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে তার বাইরেও অন্য শক্তির সন্ধান আমাদের অবশ্যই করতে হবে। বিদ্যুৎশক্তি ছাড়া মানবজাতিকে চিন্তা করাই যায় না। এই শক্তি মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষ এগোতে পারবে না। এটা না থাকলে মানবসভ্যতা আজও বহু পিছিয়ে থাকত। যে বিদ্যুৎ নিত্যদিনের কাজে আমরা ব্যবহার করছি, তার বেশির ভাগই উৎপাদন করা হয় গ্যাস ও কয়লা পুড়িয়ে। এই বিদ্যুৎকে বলা হয় তাপবিদ্যুৎ। এর পাশাপাশি পানিবিদ্যুৎও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই দুই ধরনের বিদ্যুৎশক্তি বর্তমান চাহিদা মেটাতে পুরোপুরি পারছে না। তাই প্রায়ই শোনা যায়, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না, তাই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার পক্ষে আমরা সওয়াল করতে পারি। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যা ও বিপদের ঝুঁকি কাজ করছে। কারণ তাপবিদ্যুৎ ও পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের দুটি প্রক্রিয়াই পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পরিবেশদূষণের মাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে এই দুই বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি। যেমন তাপকেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা পোড়ানো হয়। কয়লা পোড়ালে যে ধোঁয়া সৃষ্টি হয় তাতে থাকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই মনো-অক্সাইডের মতো আরও অনেক বিষাক্ত গ্যাস। এগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস আমাদের পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছে। আজকাল বিশ্ব উষ্ণায়ন (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) বলে যে শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে এই তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো থেকে বের হওয়া গ্যাস। শুধু কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে তা নয়, এ কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এটা ব্যবহারের জন্যও নানা বিষাক্ত গ্যাস বেরোচ্ছে, যা পরিবেশকে দূষিত করছে। দূষিত গ্যাস শুধু মানুষের জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার নাম পানিবিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে নদীর পানিকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সে পাহাড়ের নিচে রাখা হয় টারবাইন। বাঁধ থেকে নিয়ন্ত্রিত হারে পানি ছাড়া হয়। ওপর থেকে নদীর পানি সবেগে নিচে পড়ে। সে পানির তোড়ে নিচে থাকা টারবাইন ঘোরে। টারবাইন ঘোরার ফলে সৃষ্টি হওয়া যান্ত্রিক শক্তিতে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। অনেকে বলতে পারেন, এ প্রক্রিয়ায় তাহলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় না। হ্যাঁ, পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ক্ষতিকর গ্যাস সৃষ্টি হয় না ঠিক, কিন্তু তা পরিবেশকে ক্ষতি করে। নদীর পানি যেখানে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা হয় তার জন্য কতটুকু জমি প্রয়োজন হয় তা অনুমান করতে পারেন? এটা এক-দুই বিঘার বিষয় নয়। পানি রাখার জন্য প্রয়োজন হাজার হাজার বিঘা জমি। বাঁধ দিয়ে আটকে রাখার ফলে প্রচুর জমি পানির নিচে চলে যায়। ফলে সেখানেও জৈববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়। বাস্তুচ্যুত হয় আশপাশে থাকা মানুষ।
এসব সমস্যার কথা মাথায় রেখে বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই বিকল্প শক্তি হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে সূর্য। হ্যাঁ, সূর্যই হতে পারে আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগানদাতা। আমাদের আলোকিত করে সূর্য থেকে আসা আলো। এই আলো হচ্ছে একধরনের শক্তি। আলোর কণাকে ফোটন বলা হয়। ফোটন শক্তির প্যাকেট আকারে আলো হয়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠেও পড়ে। এই ফোটনকে সৌরকোষের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। আপেক্ষিক অর্থে অফুরন্ত এই আলোকশক্তি পৃথিবীতে আসছে। এই শক্তিকে যদি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায় তাহলে আমাদের শক্তি উৎপাদনের দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। তার মানে এটাও নয় যে মানুষ আলোকশক্তির পুরোটাই বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারবে। এটা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক এটা চিন্তা করাও মূর্খামি হবে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পর্কে আরেকটা প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। অনেকে বলেন, আকাশ মেঘলা থাকলে তো বাতি জ্বালবে না। কারণ তখন ব্যাটারি চার্জ হবে না। তখন কি হবে? প্রশ্নটা স্বাভাবিক। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটা বিষয় বুঝতে হবে, সৌরশক্তি বলতে কী বোঝায়। সূর্য থেকে আমরা দুই ধরনের শক্তি পাই। তাপ ও আলো। দুটি ভিন্ন শক্তি আমরা পাই। এই শক্তিগুলো আলাদা। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আমাদের চাই আলো, তাপ নয়। আলোর মধ্যে নিহিত থাকা শক্তিই এখানে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হয়। বর্ষার দিনে কি দিনের বেলা পুরোপুরি অন্ধকার থাকে? না। মেঘলা আকাশ থাকলেও আলো থাকে। হ্যাঁ, মেঘলা দিনে সূর্য মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে, যার ফলে আলোর পরিমাণ মেঘমুক্ত পরিষ্কার দিনের চেয়ে কম আসে। ফুটফুটে দিনের তুলনায় মেঘলা দিনের আলোর পরিমাণ কম। অর্থাৎ মেঘলা দিনে ব্যাটারি একবারে চার্জ হবে না, বাতি জ্বলবে না- এরকম দুশ্চিন্তা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। মেঘলা দিনেও সৌরকোষ তার কাজ করে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট