সেনাসহ সশস্ত্র বাহিনীর যাবতীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ পারার জন্য, না পারার জন্য নয়। আরও পরিষ্কার করে বললে সাফল্যের জন্যই তাদের যত দীক্ষা। না পারা বা ব্যর্থতা থাকতেই পারে- এ মন্ত্র তাদের দেওয়া হয় না। সাফল্য ও জয়ের তালিমে কেবল সামনে এগোয় তারা, পেছনে তাকায় না। তা হোক সমতলে বা পাহাড়ে, দেশে বা বিদেশে। সাফল্যের এ ধারায় ১৯ বছর পর যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদান থেকে ময়নুলকে দেশে ফিরিয়ে আনার এক অসম্ভব সম্ভব হলো সেনাবাহিনীর কল্যাণে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তালুকবাজিত গ্রামের রজ্জব আলীর ছেলে ময়নুল হক ঠিকাদারির কাজে সুদানের রাজধানী খার্তুমে পাড়ি জমান ১৯ বছর আগে। হঠাৎ শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয় সেখানে।
বহুদিন অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার পর প্রাণ বাঁচাতে একপর্যায়ে পালিয়ে চলে আসেন আবেই অঞ্চলে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে হারিয়ে ফেলেন পাসপোর্টসহ সব নথিপত্র। এতে তার দেশে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০২২ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ‘ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেই’ তে বাংলাদেশের একটি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন রয়েছে। গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন, ব্যানব্যাট-৩-এর একটি টহল দল আবেই বাজার এলাকায় হঠাৎ ময়নুল হকের সন্ধান পায়। তাদের পেয়ে দেশে ফেরার প্রবল আকুতি জানান ময়নুল। আবেইতে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করে। তার দেশে ফেরার আবেদন সেনাসদরে পাঠানো হয়। পরে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে আবেদনটি পৌঁছানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। গত ১৫ আগস্ট ইথিওপিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাস তার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ‘ট্রাভেল পারমিট’ ইস্যুর ব্যবস্থা করে। ময়নুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে দূতাবাস তার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের বিমানভাড়া এবং আনুষঙ্গিক আর্থিক সহায়তা দেয়। এরপর ২৯ অক্টোবর সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আবেই থেকে তাকে বিমানে জুবা সাউথ সুদানে আনা হয়। জুবা সাউথ সুদান থেকে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমানে গত রবিবার ঢাকায় পৌঁছেন ময়নুল।
বাংলাদেশে ফিরতে পেরে ময়নুল হক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এমন অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান সেনাবাহিনীর কাছে। এমন মানবিক কাজের সম্পৃক্ততা সেনাবাহিনীর ব্যাপক বিস্তর কাজের খণ্ডচিত্র মাত্র। জাতিসংঘ মিশনে সেনাদের সাফল্য মূলত সংঘাত নিরসন, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের মধ্যে নিহিত। এসব সাফল্য বিশ্বমঞ্চে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অঙ্গীকারের প্রতিফলন। জাতিসংঘ মিশনে সেনাদের অংশগ্রহণের ফলে কম্বোডিয়া, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, মোজাম্বিক, নামিবিয়াসহ অনেক দেশে সংঘাতের অবসান হয়েছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ১৯৮৮ সাল থেকে অবদান রাখা শুরু করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন সংকটপূর্ণ অঞ্চল যেমন কঙ্গো, দারফুর, লিবিয়া, হাইতি, সিয়েরা লিওন, দক্ষিণ সুদান, মালিসহ আরও অনেক দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী সদস্যরা কঠিন পরিবেশে কাজ করার সময় মানবিকতার মহত্ব বজায় রেখে সংহতি, বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই অবদানের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রশংসায় ‘শান্তির কূটনীতির মোরসাল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নারী সদস্যরাও শান্তিরক্ষী হিসেবে গৌরবের সঙ্গে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকদের জীবন, সম্পত্তি এবং মানবাধিকার রক্ষায় সেনারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। দুর্যোগ বা সংঘাতের সময় মানবিক সহায়তা, যেমন খাদ্য, পানীয় জল এবং চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে তারা সাহায্য করে। বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তারা বিভিন্ন মিশনে ফোর্স কমান্ডার ও ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অত্যন্ত ইতিবাচক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ আরও শক্তিশালী ও সুচারুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামরিক কূটনীতির প্রতি তাঁর সবিশেষ মনোযোগ বাংলাদেশের জন্য বিশ্বে মর্যাদা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়েছে। বিশ্বে শান্তি সুরক্ষার এই সুদীর্ঘ পথে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ফলে কেবল সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়নি, বাংলাদেশের কূটনৈতিক শক্তি ও মানবিক ভাবমূর্তিও আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম এবং সেই সঙ্গে পূর্বতন থেকে বর্তমান সেনাপ্রধানের যোগ্য নেতৃত্ব প্রশংসার দাবিদার। তবে শান্তিরক্ষা মিশনের চ্যালেঞ্জও কম নয়। বিপজ্জনক পরিবেশ, বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হুমকি এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে কাজ করতে হয় শান্তিরক্ষীদের। সেই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় ভাবাবেগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতা ও সহনশীলতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। যা তাদের নিজ দেশেও শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করছে। চোখ মেললেই তার দেখা মিলছে। দেশের এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। আর আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা।
জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে। মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশি কাজও করে চলছে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বসভার সদস্যদের প্রতিক্রিয়ায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জনগণের ওপর দমনপীড়নকে রোধ করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
এবারের পট পরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কী রকমের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি হয়েছে, কত সড়ক-মহাসড়কে অবরোধ হয়েছে, কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, সরকারি সংস্থা অথবা অফিস-সংক্রান্ত জটিলতা হয়েছে, অনেকেরই এ-সংক্রান্ত ধারণা নেই। সেনাসদস্যরা সেগুলো ফয়সালা করেছেন। টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে অপ্রীতিকর ঘটনার সমাধানও করেছেন। গণ আন্দোলনের আগে ও পরে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা অনেকেরই অজানা। এ সময়টাতে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) হাত থেকে স্থানীয় নিরীহ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সেনাবাহিনীকে কেবল বিশেষ যৌথ অভিযান নয়, জীবনবাজি রেখে কাজ করতে হয়েছে। এখনো করছে। শত শত কেএনএফ সদস্য ও তাদের সহায়তাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়সহ নানা ধরনের বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ, সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। এসব কাজ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহতও হয়েছেন। গেল বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির কর্মকর্তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে কাজ করছেন কোনো হাঁকডাক বা শোডাউন ছাড়াই, যার সুবিধা পেয়ে আসছে গোটা দেশ।
কাজ ও দায়িত্ব বিবেচনায় দেশে দেশে বিভিন্ন বাহিনী ও মহল কিছু বিশেষণ ধারণ করে। তা বাংলাদেশেও আছে। এখানে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। তার মানে এই নয়, আর কারও বিবেক নেই। সম্বোধনটি আসলে এই পেশার প্রতি বিশেষ সম্মানের বিষয়। এভাবে আইনজীবীদের বলা হয়, ‘লার্নেড ল ইয়ার’। শিক্ষকদের ডাকা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ নামে। আলেম-ওলামাদের সম্মান করা হয় হজরত, হুজুর, মোহতারাম ইত্যাদি সম্বোধনে। আর পুলিশের সঙ্গে যোগ করা হয় ‘জনগণের বন্ধু’। এসব সম্মানজনক বিশেষণের মর্যাদা কে কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন, তা বলা বা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। সেনাবাহিনী তার ‘দেশপ্রেমিক’ বিশেষণের সম্মান অক্ষরে অক্ষরে রাখতে পেরেছে এবং তা বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রশংসিত। একটি রক্তাক্ত পরিস্থিতি কেবল মোকাবিলাই করেনি, সাহসী মধ্যস্থতায় চমৎকার ফয়সালা রচনায় সেনাপ্রধান, তাঁর কলিগ ও বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা ছিল অনেকের কাছে অকল্পনীয়। সেনাবাহিনীর এমন ভূমিকাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ চিহ্নিত করছেন ম্যাজিক নামে। সেনাবাহিনী সেদিন কেবল রাজনৈতিক ফয়সালায় ভূমিকা রাখেনি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়ও দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে। দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। গুরুতর আহত কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর এখন সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর অভিযাত্রার আকাঙ্ক্ষা জনমনে। সেনারা পারে, পারছে বলে সামনেও পারবে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উচ্চাশার এ পারদ।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট