সিনেমা হলের নাম ‘রূপভারতী’। যে শহরে আমার বাড়ি, সেখান থেকে উত্তর দিকে সাত মাইল দূরে এর অবস্থান। বিরাট এক বাণিজ্য কেন্দ্রের মধ্যস্থলে হওয়ায় এখানে দর্শক উপচে পড়ে। হাটের দুই দিন (শনি ও মঙ্গলবার) তো জলপথে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মানুষও এখানে ‘বই’ দেখতে আসে। ‘সাগরিকা’ নামক সিনেমাটি এখানে আমি আর আমার বাল্যসখা হারুন, খোকন ও ফারুক পাঁচবার দেখেছি। ওই ছবির ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে’ গানটি খোকন মুখস্থ করে এমনভাবে গাইতো শুনে মনে হতো শ্যামল মিত্র সশরীরেই আমাদের আড্ডায় এসে গাইছেন।
ওই সময়টায় পাকিস্তানের পূর্বাংশের সিনেমাখোর শিক্ষিত বাঙালি যুবকরা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একেকজন নিজেকে উত্তমকুমার এবং যুবতীরা একেকজন নিজেকে সুচিত্রা সেন মনে করে তৃপ্তি পেতেন। সাগরিকা সিনেমা উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত। তাঁদের অভিনীত ‘শিল্পী’ দেখতে গিয়ে নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগেছিলাম। দৃশ্যটা কল্পনা করে, অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পরে, আজও একধরনের আমোদ পাই। সেই আশঙ্কা-উত্তর পর্বে দারুণ একটা তথ্যও পেয়েছিলাম। পেয়ে মনে হয়েছে, লোককথায় যা বলা হয় তার সবই ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিছু কিছু বাক্য দারুণ অর্থবহ। যেমন বলা হয়, নিজ চোখে যা দেখ তাকেই চরম সত্য বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। চাঁদনী রাতে মেঠো পথে সাপ দেখে ভয়ার্ত মানুষ লাঠি সন্ধান করে। খুব কাছে গিয়ে দেখে যাকে সাপ ভাবা হয়েছিল, সে আসলে পরিত্যক্ত একটা দড়ি।
‘শোল মাছ মহৌষধি’ মর্মে একটা প্রবচন রয়েছে। ছায়াছবি ‘শিল্পী’ দেখার আগে কল্পিত নিরাপত্তাঝুঁকি পর্বে ওই কথাটার সার্থকতার প্রমাণ দিয়েছিল জামালউদ্দিন ওরফে ‘জামাইল্যা চোরা’। এরশাদীয় শাসনকালে শামসু নামে ৭৫ বছর বয়সি এক পকেটমার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পত্রিকায় খবরে জানা যায়, শামসু ১৫ বছর বয়স থেকে ওই পেশায় রয়েছে। পকেটমারদের আন্তজেলা যে নেটওয়ার্ক তাতে ‘শামসু ওস্তাদ’ হিসেবে তার পরিচিতি। কোন জেলায় কে পকেটমার সর্দার তার বর্ণনা দেওয়ার সময় শামসু বলে, অমুক জেলার সর্দার জামাইল্যা।
‘ডরান কিয়েল্লাই?’ : আমাদের মহল্লায় পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে জামালউদ্দিন। আমরা চার বন্ধু ওকে মৃদু মারধর করে ছেড়ে দিই। মুক্তি পেয়ে যেতে যেতে সে বলে ‘খাড়া, তোগোরে চৌমুহনী বাজারে পাইয়া লই। ছ্যাঁচা দিয়া হালুয়া বানাইয়া ফালামু।’ পাড়াতুতো ছোট ভাই চুকু জানায়, ‘চোরায় তো আমনেগোরে সুমুন্দির পোলা কইয়া গাইলাইছে।’ এমতাবস্থায় তো চুকুর কাছে আমাদের ইজ্জত থাকে না। পলায়নপর জামালকে ধাওয়া করে আমরা পিটুনি দিলাম। পাবলিকও আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। দুই গোষ্ঠীর সম্মিলিত পিটুনির চোটে জামালের মুখ দিয়ে ফেনা বেরোয়। পিটুনিদাতা সিনিয়র এক সিটিজেন বলেন, খাইছে! পোলা তো মরতেছে। হাসপাতালে নিতে হবে।
সিনিয়রের সঙ্গে একমত আমরা। তবে পালিয়ে যাওয়াটাই সংগত মনে করি। হত্যা মামলার আসামি কে হতে চায় গো, কে হতে চায়? বিকালে সংবাদ পেলাম, সদর হাসপাতালে দুই নম্বর ওয়ার্ডে 
জামালের চিকিৎসা চলছে। আঙুর, বিস্কুট আর কমলার সিরাপের বোতল হাতে আমরা তাকে দেখতে যাই। দেখি, জামালের বেড খালি। পুলিশের ভয়ে সে পলাতক। মাঝখানে বছর দেড়েক পার। ছায়াছবি ‘শিল্পী’ দেখার আগে যে রেস্তোরাঁয় আমরা চা-শিঙাড়া খাচ্ছি সেখানে টেবিলে আমার সামনে বসা এক ব্যক্তি বলেন, মার্চাব (আমাদের এলাকায় নিরক্ষর শ্রেণির লোকরা ছাত্রদের ‘মাস্টার সাব’ বলে সম্মান দেখায়। দ্রুত উচ্চারণে ওই কথাটাই হয়ে গেছে ‘মার্চাব’) ভালা আছেননি? লোকটার গলায় রঙিন মাফলার, নীল রং ফুল শার্ট, মুখময় বসন্তের দাগ। তাকে বলি, আপনি আমায় চেনেন? জবাবে সে বলে, চিনুম না? মাইরতে মাইরতে জান বাইর কইরা ফালাইতেছিলেন! খোকন ও ফারুককে দেখিয়ে সে বলে, আপনার লগে এই দুই মার্চাবও হাত চালাইছিল। হারুনও আমার পাশে বসা; তার চেহারা লোকটার মনে নেই।
শুনেছি পকেটমারদের সংঘশক্তি প্রবল। জামালের আপন আদমিরা আশপাশে থাকতেই পারে। চার পিটুনিদাতাকে বস্তায় পুরে ওরা লাথি উষ্ঠায় উদ্যত হলে? বললাম ভুল করছেন ভাই। আমরা না। অন্য কেউ হতে পারে। এক মানুষের চেহারার সঙ্গে অন্য মানুষের মিল হতেই পারে। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘চোররে পিটাইছেন। খারাপ কিছু তো করেন নাই। স্বীকার করতে ডরান কিয়েল্লাই অ্যাঁ?’
হাওয়া মন্দ না। জামালের জন্য প্রাণহরা আর চায়ের অর্ডার করলাম। ফারুক বলে, আপনি তো সিরিয়াস কন্ডিশনে ছিলেন। সেরে উঠলেন ক্যামনে? জামাল উদ্দিন জানায়, আস্ত একটা শোল মাছ কাঁচা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে। শোল মাছে মহাশক্তি। রোগীরা রান্না করা শোল খায়। অপরাধীরা খায় কাঁচা। খায় আর উপকার পায়। পিটুনিতে মরণাপন্ন জামাল খালার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তিন দিন ধরে দু’বেলা কাঁচা শোল খেয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়।
মোষ-মেষ বেশ বেশ : ‘শক্তির সন্ধানে খাওয়া, শক্তির সন্ধানে যাওয়া, শক্তির কারণে পাওয়া, শক্তির কারণে খোয়া- এই সিস্টেমে দুনিয়া লেফট রাইট করছে। শক্তির চাহিদা কখনো শেষ হয় না। প্রমাণ চাও? রাজধানীর খাবারের দোকানগুলোয় গিয়ে গজার মাছের অর্ডার দাও। পাবে না। বেয়ারা বলবে, আমরা শোল মাছ রাঁধি। গজার কখনো না।’ বলেছিলেন নাজিম সেলিম বুলবুল। গুণী সাংবাদিক-লেখক বুলবুল ভাই এসব কথা শুধু বলতেনই না, নিবন্ধ আকারে লিখতেনও। এক নিবন্ধে লিখেছেন, দেশের ৬৪ জেলার প্রতিটিতে যদি মাসে ৪০ কেজি করে গজার ধরা পড়ে তাহলে ২৫৬০ কেজি। তার মানে বছরে ৩০৭২ কেজি গজার ধরা পড়ছে। আর শহর বন্দরের হোটেলে এসে তারা শোল হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহক খায় আর বলে, পোক্ত শোল। কিন্তু একটুও টেস্ট পাচ্ছি না। অবস্থাটা ট্রেনের ভিতরকার ভিড়ের কেচ্ছার মতো। এক যাত্রী তার পাশের যাত্রীকে বলছে, ‘কী হলো ভাইসাব। অনেকক্ষণ ধরে আমার পিঠ চুলকিয়েই যাচ্ছেন আর যাচ্ছেন।’ উত্তরে পাশের যাত্রী বলে, ‘তাই তো বলি, ঘটনা কী? এত চুলকাই আরাম পাই না কেন।’
অঙ্কনশিল্পী কালাম মাহমুদ বলেছিলেন, ঢাকা শহরে সূর্য ওঠার একটু আগে চক্কর দিলে দেখবে একের পর এক ঠেলাগাড়ি জবাই করা মোষ নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকাতেই এই দৃশ্য। কিন্তু বাজারে মোষের মাংস পাবে না। এগুলো যায় কোথায়? যায় আমাদের পেটে। ‘গরু’ বলে মোষের মাংস গছিয়ে দেওয়া হয় আমাদের। হাজার হাজার ভেড়া জবাই হয় ঢাকায়। দোকানে আর হোটেলে সেগুলো খাসির গোশত নামধারণ করে চলছে তো চলছেই। মোষ আর মেষ, তারা এই শহরে বিকোচ্ছে ইজ্জতের সঙ্গেই। বল বেশ বেশ!
সেকাল-একাল : অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এর সিনিয়র রিপোর্টার জালিল আহমেদ, ‘পুরাকালের সবই ভালো, একালে কিছু কিছু ভালো’ তত্ত্বের অনুরাগী। তাঁর লেখা কবিতা ও ছড়ায় এই অনুরাগের ছায়া থাকত। ফকিরাপুলের এক রেস্তোরাঁয় আড্ডায় ভোজনকালে হঠাৎ হঠাৎ তিনি তাঁর লেখা পড়ে আমাদের শোনাতেন এবং মতামত জানতে চাইতেন। আমরা বলতাম, আরেক প্রস্থ কাবাব খাওয়া বিনা মন্তব্য উদ্গিরণ কঠিন হইয়া পড়িবে। জালিল ভাই বলতেন, পদার্থের রূপান্তর অনুমোদন অনুচিত। যাহা কঠিন তাহাকে কঠিন অবস্থায় থাকিতে দেওয়া সভ্যজনের জন্য শোভন কর্ম হয়।
আহা সেই জালিল আহমেদ এখন সুদূর আমেরিকায় কবরে শায়িত। সে দেশে সংসাররত মেয়েকে দেখতে গিয়ে হার্টফেল করে লোকান্তরে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত একটি কবিতায় আছে- ‘জেলের জালে আগের মতোই ইলিশ পড়ে ধরা/খাচ্ছি তারে চেটেপুটে তবে স্বাদের অতি খরা/বাগান আছে ফোটে ফুল নাই কাছে মোর সই/গোলাপ হাসে এদিক ওদিক সুবাস তাহার কই/সুবাস-লোটা খাটাসটারে খুঁজছি যদি পাই/নিমিষে ওর প্রাণটারে করে দেব নাই।’
দুই নম্বরি মুগডাল বিপণনের কেচ্ছা পত্রিকার পাতায় পড়তে পড়তে জলিল আহমেদকে মনে পড়ে। তাঁর কবিতার আদলে আমরা ক্রেতাসাধারণরা বলতে পারি, মুগ পাওয়া যায় এই দোকানে, মুগ বিক্রি হয় সেই দোকানে মুগের গন্ধ কই। স্বাদু খিচুড়ি খাওয়ার আশায় দোকান থেকে কিনে বাড়িতে এনে দেখা যায় খিচুড়িতে সবই রয়েছে, মুগের গন্ধ নেই। থাকা সম্ভবও নয়। কেন না অতিমুনাফার লোভে ‘মথ’ নামক ডালকে রঙে রাঙিয়ে মুগডাল সাজানো হয়েছে।
আমার কর্মগুরু আওয়াল খানের প্রিয় ডাল ছিল সোনা মুগ। খিচুড়ি আর ঘন করে পাকানো দুটোতেই সোনা মুগ উপভোগ করতেন তিনি। আমায় খাঁটি মুগ চেনার উপায় শিখিয়েছিলেন তিনি। এক চিমটি মুগডাল দুই হাতের চেটোয় কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করলে সুবাস না ছড়ালে সেটা ভুয়া। কৃত্রিম রং থাকলে চেটোর ঘষাঘষিতে সেই রং উঠে যাবে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২৯ অক্টোবর (২০২৫) এক বিজ্ঞপ্তিতে নকল মুগডাল বিষয়ে সাবধান থাকার ডাক দিয়েছে। বলেছে, গেল অর্থবছরে মুগডালের দ্বিগুণ পরিমাণ মথ ডাল আমদানি করা হলেও কোনো দোকানেই মথ বিক্রি হতে দেখা যায়নি। মথ আমদানি হয় ভারত ও মিয়ানমার থেকে। এর দানা ছোট, লম্বাটে। দেখতে মুগের মতো; রং হালকা বাদামি বা হালকা হলুদ। রান্না হলে সহজে গলে না। অন্যদিকে মুগডাল উজ্জ্বল সবুজাভ হলুদ। তুলনামূলক গোল, হালকা মিষ্টি ও সুগন্ধি। মথে প্রোটিন ও আঁশের পরিমাণ ভালোই। তবে মুগের তুলনায় কিছুটা কম। মথকে বিপজ্জনক খাদ্য করে তোলে কৃত্রিম রং।
টাব্বুশ ভাগ্য : যে এলাকায় জন্মেছি সেখানকার সংস্কৃতিতে স্তম্ভিত হওয়াকে বলে ‘টাব্বুশ হওয়া’। পরের পিঠ চুলকিয়ে ‘মজা পাই না কেন’ ধরনের পরিস্থিতিতে ভুগে টাব্বুশ হয়েছিলাম আরকি। বাবার নির্দেশ ছিল, সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকা চলবে না কিন্তু বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলাম মধ্যরাতের পরে চুপিচুপি। এভাবে ফিরলে নিঃশব্দে বিছানায় চিৎপাত হই। সে রাতে ওটা সম্ভব হলো না। ভীষণ খিদে। বাবার বকুনির ভয়ে চোরের মতো ঢুকেছি রান্নাঘরে। বাতি জ্বালানোর সাহস হয় না। অন্ধকারে মিটসেফ হাতড়ে প্লেটে নেওয়া হলো ভাত, মাছ, তরকারি। মাঝারি সাইজের গামলায় হাত দিয়ে বুঝলাম ডাল।
চামচ দিয়ে ডাল নাড়াচাড়া করি। দু’চামচ ডাল নিলাম। স্বাদ নেই। খুবই পানসে। স্বাদের জন্য প্লেটে লবণ নিয়ে তার সঙ্গে ফের যোগ করি দু’চামচ ডাল। নাহ্, কোনো স্বাদ পাই না। পরদিন সকাল ৯টায় কাজের বুয়াকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলি, কী ডাল যে রাঁধো। কোনো স্বাদ নাই। এক্কেরে পানির মতো। বুয়া বলে : ডাইলের কোনো দোষ নাই মামু। ওই বাটিতে ছিল বাসন ধোয়া পানি। স্বাদ পাইবেন কোত্থুন?
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন