শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

গল্প সংকটে ঢাকাই চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

গল্প সংকটে ঢাকাই চলচ্চিত্র

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের পারিপার্শি^কতা। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এর জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। এক সময় সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ জামান চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, আশীষ কুমার লৌহ, এটি এম শামসুজ্জামান, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, এসএম পারভেজ, আবদুল জব্বার খান, আমজাদ হোসেনের মতো গল্পকারদের গল্পে কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। এখন গল্পকারের আকাল চলছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালেও দেখতে পাই সেখানে বাণিজ্যিক এবং মৌলিক, উভয় ধারার সমৃদ্ধ সময় উপযোগী গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। যা ঢাকাই চলচ্চিত্রে নেই। মানে গল্প আর গল্পকারের সংকটে পড়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র।

সম্প্রতি ঈদে মুক্তি পাওয়া শাকিব খান প্রযোজিত ও অভিনীত ‘পাসওয়ার্ড’ ছবিটি একটি বিদেশি ছবির নকল বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে শাকিব খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো গল্প আর গল্পকার কোথায়? এক বছরের বেশি সময় আগে একজন গল্পকারকে গল্প লিখতে দিয়েছিলাম। সম্মানী হিসেবে তাকে এক লাখ টাকাও অগ্রিম দেওয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই গল্প হাতে পাইনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে নানা অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করেন। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে দেশীয় গল্পের অভাবে বাধ্য হয়ে বিদেশি গল্প বা ছবির অনুকরণ করতে হয়। না হলে এই শিল্প টিকবে কী করে? যারা চলচ্চিত্র পেশার সঙ্গে যুক্ত তাদের তো বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচতে হবে।

১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ঢাকার প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। একজন ডাকাতের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এটি ছিল পারিবারিক গল্পের ছবি। একটি সমৃদ্ধ ও সময়োপযোগী গল্প বলে দর্শক সাদরে গ্রহণ করে ছবিটি। এই ধারাবাহিকতায় নির্মিত হতে থাকে আকাশ আর মাটি, মাটির পাহাড়, এদেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, কখনও আসিনি, সুতরাং, বেহুলা, মনের মতো বউ, নয়নতারাসহ প্রচুর গল্পসমৃদ্ধ ছবি। একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো-  নানা, নানি, দাদা, দাদি, মা, বাবা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়-স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। আর এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এ কারণেই ৫০ থেকে ৮০-এর দশকের চলচ্চিত্রের ছিল স্বর্ণালি যুগ। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- রূপবান, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, সারেং বৌ, অবুঝ মন, ময়নামতি, ছুটির ঘণ্টা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, অশিক্ষিত, অশ্র“ দিয়ে লেখা, স্বরলিপি, হাজার বছর ধরে, হাছন রাজা, নবাব সিরাজদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, সাতভাই চম্পা প্রভৃতি। আশির দশক পর্যন্ত এ জাতীয় সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র প্রচুর পাওয়া গেছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা মৌলিক গল্প বিবর্জিত হিন্দি ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে গাঁজাখোড়ি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়ে। এই অবস্থা এখনো চলছে। এরপর শুরু হয় অশ্লীলতার দাপট। মাঝে মধ্যে দু-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আকতার বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছবিতে গল্প খুঁজে পাওয়া যেত। আর তাতে নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে দর্শক সিনেমা হলে ভিড় করত। এখনকার ছবিতে গল্পের সংকট। এখন ছবিতে আর নানা-নানি, দাদা দাদি তো দূরে থাক মা-বাবাই থাকে না। এখন একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আর একজন খলনায়ক আর আইটেম গান থাকলেই নাকি ছবি হয়ে যায়। এসব ছবি দর্শক কখনো গ্রহণ করবে না। বর্তমান প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসিবুর রেজা কল্লোল বলেন, এখনকার ছবিতে গল্পই নেই। বর্তমানে মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছেন তাতে সময়োপযোগী প্রযুক্তি ও যাপিত জীবনের উপকরণ নেই। এসব গল্প ও জীবনবোধের ছায়া নেই বলে দর্শক তা দেখে না।

এদিকে চলচ্চিত্রে গল্পের অভাব কাটাতে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি  মৌলিক গল্প, চিত্রনাট্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। আগ্রহী গল্পকার বা চিত্রনাট্যকারদের আগামী তিন মাস পর্যন্ত নিজের নাম, ঠিকানা,  টেলিফোন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিসহ গল্প বা চিত্রনাট্য এ ফোর সাইজের কাগজে টাইপকৃত অবস্থায় পরিচালক সমিতিতে জমা দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। অথবা পরিচালক সমিতির ই-মেইলে ((bangladeshfilm [email protected]) চাইলে চিত্রনাট্য পাঠাতে পারেন। সঙ্গে ৫০০ টাকা জমা দিয়ে সমিতি থেকে একটি রসিদ সংগ্রহ করতে হবে। এ জন্য প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার ছটকু আহমেদকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর