বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্ক্রিপ্ট নেই, শুধু গল্পেই নির্মিত হচ্ছে নাটক

স্ক্রিপ্ট নেই, শুধু গল্পেই নির্মিত হচ্ছে নাটক

ভালো নাটক নির্মাণের জন্য ভালো স্ক্রিপ্ট খুবই জরুরি। ইদানীং স্ক্রিপ্ট ছাড়াই শুধু গল্প দিয়ে নাটক বানানো ট্রেন্ড চালু হয়েছে। এ কারণে নাটকে কোনো  বৈচিত্র্যতা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে ভালো নাট্যকারের সংখ্যাও কম। তাই মানহীন নাটক নির্মিত হচ্ছে। অনেকের মতে, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বাজেট আর ভিউ নিয়ে মাতামাতি। এই বিষয়টি নিয়ে নাট্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন-  পান্থ আফজাল

 

আসাদুজ্জামান নূর

এখন তো ভালো নাট্যকারের অভাব, স্ক্রিপ্টের অভাব। এই অভাবটা একই সঙ্গে মঞ্চে এবং টিভিতে। নতুন নাট্যকার সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। তেমন করে তাদের ভালো স্ক্রিপ্ট পাচ্ছে না থিয়েটার বা টিভি নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। একসময় দুর্দান্ত সব নাট্যকার ছিলেন। তাদের লেখা নাটক টিভিতে ও মঞ্চে মঞ্চস্থ হতো। দর্শক মুগ্ধ হয়ে সংলাপ শুনতেন। মুখস্থও করে ফেলতেন সেই সব সংলাপ। আমাদের সময় নাটক ছিল ভিন্ন স্বাদের। শুটিং শেষ করেছি সুন্দরভাবে। স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়েছি অনেক আগেই। বিটিভিতে সন্ধ্যার পর সবাই মিলে নাটকের রিহার্সেল করেছি; সঙ্গে জম্পেস আড্ডা তো চলতই। এখন তো সবাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। নাটকে নেই কোনো অ্যাকশন-রিয়েকশন!

 

আবুল হায়াত

আমি এটা সমর্থন করি না। নাটক নির্মাণ একটি চিন্তা-ভাবনার বিষয়। এই চিন্তা শুধু পরিচালকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, আর্টিস্ট, নাট্যকার ও অন্য কলাকুশলীদের মধ্যে থাকতে হবে। সবার ক্রিয়েটিভিটি মিলেই একটা প্রোডাকশন হয়। পরিকল্পনা করে করা আর দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক সংলাপ ডেলিভারি দেওয়া এক নয়। এটি একটি যৌথ শিল্প। নাটকে স্ক্রিপ্ট অনেক সময় থাকে না। দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলা হয়, এইটা করেন, ওইটা বলেন। এটা তো হয়ে যায় উপস্থিত নাটক। আমরা জিম্মি হয়ে গেছি। টাকা বাঁচানোর জন্য নাট্যকারের কাছ থেকে স্ক্রিপ্ট নিচ্ছে না। চরিত্রের কাটছাঁট করা হচ্ছে। আর এখন তো কোয়ালিটির চেয়ে পপুলারিটির দাম বেশি।

 

চঞ্চল চৌধুরী

গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের নাটকে সিরিয়াস ও মানবিক গল্পের প্রাধান্য বেশি ছিল। ভাঁড়ামি ট্রেন্ড থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে; ভাঁড়ামি নাটক তুলনামূলক কম হয়েছে। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে নাটকের মূল সমস্যা স্ক্রিপ্টিং। এই দুর্বলতা রয়েই গেছে। অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক গল্প দিয়েই নাটক নির্মিত হচ্ছে। তাই স্ক্রিপ্টিং নিয়ে খুবই বিব্রত ও বিরক্ত! ভালো স্ক্রিপ্টের অভাব খুব অনুভব করি। হুটহাট করে লিখলেই তো আর হয় না! বেশির ভাগ সময় শুটিং করতে গিয়ে দেখি ২৫টি সিকুয়েন্সের মধ্যে ২৫টিই আমার! প্যারালাল ক্যারেক্টার তেমন করে নেই বললেই চলে। দুই-একজনের বেশি চরিত্র নেই। কোনো প্রিপারেশনও নেই। এখন তো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই শুধু গল্পের ওপর ভর করে নাটকের শুটিং হয়। আগে তো ফুল স্ক্রিপ্ট পড়ে শুটিং করতাম। এখন মূল স্ক্রিপ্ট হাতে পাই শুটিংয়ের একদিন আগে বা আগের দিন রাতে। অনেকেই সিস্টেম ব্রেক করছে। এই সমস্যা পরিচিত নির্মাতাদের মধ্যেই বেশি। তাদের অনুরোধে সিনোপসিস পছন্দ হলে শুটিং করতে হয়।

 

লাকী ইনাম

এই বিষয়টি সমর্থন করার প্রশ্নই আসে না। স্ক্রিপ্ট লাগবেই। স্ক্রিপ্ট দেখবে, পড়বে, সে অনুযায়ী চরিত্র নিয়ে চিন্তা করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। আমি অবশ্য এই অবস্থায় কখনো পড়িনি। আমাদের সময় তো স্ক্রিপ্ট ছাড়া কোনো নাটকই হতো না। স্ক্রিপ্ট আগে হাতে পেতাম, তারপর পড়তাম, চরিত্র বুঝে নিতাম, রিহার্সেল করতাম। এরপর সব ঠিকঠাক মতো প্রস্তুত হলে তবেই ফাইনালি অভিনয়ে যাওয়া হতো। এখন তো এসব বিষয় কেউ ভাবে না। অভিনয়ে নেই বৈচিত্র্য, নাট্যকার তেমন করে নেই। দক্ষ অভিনয়শিল্পীর অভাব। স্ক্রিপ্ট ছাড়া শুধু গল্পে  নাটক নির্মাণ কেন হচ্ছে? এটি নিয়ে সবাই মিলে প্রতিবাদ করা উচিত। এটি একটি পেশা। একাত্ম হয়ে কথা বলতে হবে। তাহলে অন্তত একটা পরিবর্তন আশা করতে পারি।

 

অমিতাভ রেজা

নাটক নির্মাণে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। যার যেভাবে ভালো লাগে সে সেভাবে নির্মাণ করে। নাটক তো একপ্রকার ফিল্ম। নাটক বা সিনেমা যাই বলি না কেন-এটার নির্দিষ্ট কোনো রুলস নেই। নির্দিষ্ট কোনো ফরমেটে বাঁধা নেই। দিনের শেষে স্ক্রিনে যা দেখা যাবে তাই ফাইনাল। স্ক্রিপ্ট বা গল্প নিয়ে নির্মাণ-কোনো বিষয়ই ম্যাটার করে না। নাটক বা সিনেমা করতে স্ক্রিপ্ট তেমন করে গুরুত্ব বহন করে না। বানাচ্ছে অনেকেই। ভালো করছে তারা। এটা একটা গৎবাঁধা নিয়মে আটকে ফেলা যাবে না। নিয়ম থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নির্মাণে স্বাধীন থাকতে হবে। কাজ করে যেতে হবে। গল্প দিয়ে বা স্ক্রিপ্টের ওপর নির্ভর করে সেটা কোনো ফ্যাক্ট নয়।

 

বৃন্দাবন দাস

এটার প্রচলন তো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এটা নিয়ে এর আগেও অনেক কথা হয়েছে। যখন আমরা ছিলাম না। তবে স্ক্রিপ্ট ছাড়া শুধু গল্পের ওপর ভিত্তি করেও ভালো  প্রোডাকশন হয়েছে। ইমপ্রোভাইজ করে নাটক নির্মিত হয়েছে, হচ্ছে। তবে এই বিষয়টা এখন প্রাকটিসে পরিণত হয়ে গেছে। এই প্রাকটিসটাই সর্বনাশ ডেকে আনছে। আমরা পূর্বে অগ্রজদের কাছ থেকে শিখেছি। আর এখন যে কেউ খুব সহজেই নাটক বানাচ্ছে, শিখতে হয় না এখন। নাট্যকারই তো নেই, লিখবে কে? নাট্যকারের অভাবের সেই ধাক্কা এখন প্রকট। এখন তো ইউটিউবে ভিউ দিয়ে সবকিছুর নির্ণয় হচ্ছে। ইউটিউবে ভিউ দেখে আর্টিস্ট, নির্মাতা বা গল্পকার নির্বাচন করছে চ্যানেল ও প্রযোজক। এটা ভ্রান্ত পন্থা। একটু চিন্তা করলে যে কেউ সেটা বুঝবেন। সাধারণ মানুষের কিন্তু এই ভিউভিত্তিক নাটক নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এই পন্থাটা হলো অসততা, বাণিজ্যিক। স্ক্রিপ্ট নেই, নাটক হচ্ছে- এই বিষয়টা হচ্ছে পরগাছার মতো। এটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না।

সর্বশেষ খবর