বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ → সুচন্দা

জহির রায়হানকে হারিয়ে স্বাধীন দেশ পেলাম

জহির রায়হানকে হারিয়ে স্বাধীন দেশ পেলাম

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সাংবাদিক সাহিত্যিক জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন। আজ তার অন্তর্ধান দিবস। তাকে নিয়ে কথা বলেছেন তারই সহধর্মিণী চলচ্চিত্রকার সুচন্দা। তার বলা কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

স্বাধীন দেশে জহির রায়হানকে হারালেন, কি বলবেন-

উফ্ (দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, চোখের কোণে পানি জমে ওঠেছে) যুদ্ধ চলাকালীন যদি জহির রায়হান নিখোঁজ হতেন বা মারা যেতেন তাহলে মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে পারতাম যে, যুদ্ধে হারানোটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীন দেশে কেন তাকে নিরুদ্দেশ হতে হলো? শত্রুমুক্ত একটি দেশে এ ধরনের একজন মানুষকে হারানোর বেদনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষাও থাকে না। আমার আজীবনের একটি প্রশ্ন, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে কেন জহির রায়হানকে হারালাম।

 

জহির রায়হানের মূল্যায়ন নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট?

মোটেও নয়, জহির রায়হান নির্মিত ছবিগুলো মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট নিয়ে নিল। ছবিগুলো বা এর জন্য একটি পয়সাও দিল না। বড় কষ্ট হয়, জহির রায়হানের সম্পদ তার উত্তরাধীকাররা কেন পাবে না। নিজ দেশে জহির রায়হানের কোনো মূল্যায়ন হলো না। ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় একবার জহির রায়হানের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার মতো মেধাবী একজন মানুষের জন্ম ভারতে কেন হলো না।’

 

জহির রায়হান নেই, স্বাধীন দেশ পেলেন, অনুভূতি কেমন?

দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু জহির রায়হানকে চিরতরে হারালাম। শুধু জহির রায়হান নয়, অনেক বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, আর সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে লাল সবুজের স্বতন্ত্র পতাকা এবং পৃথিবীর বুকে একটি নির্দিষ্ট মানচিত্র মানে স্বাধীন দেশ পেলাম। এই অর্জন আত্মত্যাগের। যাদের জীবনের বিনিময়ে জাতি হিসেবে নিজস্ব পরিচয় পেলাম তাদের নিয়ে গর্ব করি।

 

মনকে আনন্দে আন্দোলিত করে এমন কোনো স্মৃতি রয়েছে কি?

অবশ্যই আছে, স্বাধীন দেশে আমিই প্রথম চলচ্চিত্রকার যে কিনা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে মস্কো ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি। সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আরেকটি ঘটনা এখনো আমাকে আবেগতাড়িত করে, জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই মায়ার পরশ এখনো অনুভব করি। জাতির জনক কত যে মহান ছিলেন যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। সেদিন মনে হয়েছিল জাতির পিতা যেন আমারও পিতা। তাঁর উদার মনের ভালোবাসার কথা কোনো দিনও ভুলব না। জাতি হিসেবে সত্যিই আমরা ভাগ্যবান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ আমাদের বঙ্গবন্ধু।

 

জহির রায়হানের স্মৃতি রক্ষায় আপনার কোনো উদ্যোগ ছিল?

তার স্মৃতি রক্ষায় পারিবারিকভাবে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না কখনো। নানা প্রতিকূলতায় সেই চেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। ওই যে বললাম তার ছবি নিয়ে গেল। তাছাড়া তাকে নিয়ে তেমনভাবে কিছুই করা হয়নি আজ পর্যন্ত। তাকে নিয়ে আজও অনেকে ব্যবসা করতে চায়, তার কাজকে নিজের কাজ বলে অপপ্রচার চালায়। এটি দুঃখজনক। এতদিন এসবের প্রতিবাদ করিনি। এখন আর চুপ করে থাকব না। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেমন হাস্যকর জহির রায়হানের বেলায়ও তাই। তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল কর্মের অধিকারী একজন মানুষ। তার নামে একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করব। তার অসমাপ্ত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। ছবিটির ডাব করা বাকি আছে শুধু। এই কাজটি সম্পন্ন করে ছবিটিকে আলোর মুখ দেখানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। এছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছে জহির রায়হানকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য পারিবারিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি। তাছাড়া জহিরের কালজয়ী উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’সহ অন্যান্য রচনার চলচ্চিত্রায়ণের পরিকল্পনা রয়েছে আমার।

 

এখনো সেই প্রাণবন্ত বেহুলা। রহস্য কি?

না. না.. রহস্য বলে কিছু নেই, শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও মনের ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। মানে মনকে ভালো রাখতে হবে। আমিই তো এর জীবন্ত উদাহরণ। জহিরের সঙ্গে ঘর বাঁধার ৫ বছরের মাথায় দেশে শুরু হয়ে গেল মুক্তির সংগ্রাম। একদিকে মুক্তিযুদ্ধ অন্যদিকে আমার জীবনযুদ্ধ। কোলের শিশুদের নিয়ে জহিরের সঙ্গে আমিও দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ৯ মাসের অবর্ণনীয় ঝড়ো হাওয়ার পর একসময় পূর্ব আকাশে স্বাধীনতার সূর্য উঠল। স্বাধীন দেশে আবারও জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি আমি। মানে জহিরকে হারালাম। তারপর ছোট্ট সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু আবার, বুকের মাঝে কষ্টকে ছাইচাপা দিয়ে হাসিমুখে যুদ্ধ করে গেলাম। (আবারও দীর্ঘ নিঃশ্বাস)।

সর্বশেষ খবর