রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

টিভি নাটকেও নায়িকা সংকট

টিভি নাটকেও নায়িকা সংকট

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে টিভি চ্যানেল। সেই সঙ্গে জোয়ার বইছে ইউটিউবসহ ডিজিটাল নানা প্ল্যাটফরমের। এসব মাধ্যমে প্রচারের জন্য নির্মিত হচ্ছে অসংখ্য নাটক-টেলিফিল্ম। শত-সহস্র নাটকের ভিড়ে ঘুরে-ফিরে দেখা মিলছে একই মুখের। তাই অনেকেই বলছেন সিনেমার মতো নাটকেও চলছে নায়িকা সংকট। এমনিতেই দেশীয় নাটকের প্রতি দর্শকের বিমুখতা। তার ওপর একই মুখ দেখতে দেখতে দর্শক ক্লান্ত। লিখেছেন- আলী আফতাব

 

শিরোনাম দেখেই হয়তো বিজ্ঞদের চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্নের উদ্রেক হবে। এ আবার কেমন কথা! নাটকেও আবার নায়িকা কীসের? সবাই তো অভিনেত্রী। কিন্তু হাল আমলের নাটকেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেত্রীর প্রাধান্য এত বেশি দেখা যায় যে, সেই অভিনেত্রীকে নায়িকা না বলে উপায় নেই। অনেক অভিনেত্রী আবার নিজেকে নায়িকা বলে পরিচয়ও দেন। আসলে তাদের দেওয়া পরিচয়ের যৌক্তিকতা আছে। সত্তর কিংবা আশির দশকের নাটকে নায়িকা নামক শব্দের প্রচলন ছিল না। নব্বই দশকে যখন প্যাকেজ নাটক তৈরি এবং প্রচার শুরু হলো তখন নায়িকা শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। অপেক্ষাকৃত নবীন এবং সুন্দরী মেয়েদের চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নাটক নির্মিত হওয়া শুরু হয়। যার ফলে দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে নাটকেও নায়িকা শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়। এখন তো নাটকে এই নায়িকা শব্দটির ব্যবহার আরও বেশি প্রকট। বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধানদের কাছে। তাদের চাহিদামতো নির্মাতাদের নায়িকা নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে হয়। তার ওপর রয়েছে গ্ল্যামারাস এবং পছন্দের তালিকার চাপ। অনেক চ্যানেল থেকে নাটক নির্মাণের অনুমতির সঙ্গে নায়িকার তালিকাও ধরিয়ে দেওয়া হয়। চ্যানেলের পছন্দমতো নায়িকা না হলে সে নাটক তারা প্রচার করেন না। তাই নাটকের অভিনেত্রীকে নায়িকা বলায় কোনো বোদ্ধা যদি ভ্রƒ কুঁচকে প্রশ্নবোধক যতিচিহ্ন এঁকে থাকেন, তাদের নতুন করে ভাবার দিন এসেছে। সত্যিকার অর্থেই নাটকের তরুণ গ্ল্যামারাস অভিনেত্রীরা এখন নায়িকা।

এক সময় এখনকার মতো এত টিভি চ্যানেল ছিল না। ছিল না অনলাইন প্ল্যাটফরম। তবুও তখন একেক নাটকে দেখা গেছে একেক অভিনেত্রী-অভিনেতার অভিনয়ের জাদু। আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল হোসেন, আজিজুল হাকিম, তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান, টনি ডায়েস, মাহফুজ আহমেদ, লিটু আনাম, শফিক সাদেকি, সেলিম মাহবুব, বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, তানভীন সুইটি, তানিয়া আহমেদ, অপি করিম, রিচি সোলায়মান, বন্যা মির্জা, রাত্রী, ঈশিতা, সুমাইয়া শিমুসহ আরও অনেকে নিয়মিত নাটকে অভিনয় করতেন। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। নাটকের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শিল্পীর সংখ্যা। যার জন্য তৈরি হচ্ছে না শিল্পী। নাটকের গল্প নেই, বিজ্ঞাপন বিরক্তি, শিল্পীদের অভিনয়ে অদক্ষতা-এসব কিছু নিয়েই দর্শকের অভিযোগ। যদিও দর্শকের অভিযোগের কোনো তোয়াক্কা করেন না টিভি চ্যানেল, নির্মাতা কিংবা শিল্পীরা। তাই দেশীয় চ্যানেল থেকে মুখ ঘুরিয়ে ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতিই তাদের নজর বেশি। কথা হচ্ছিল নায়িকা নিয়ে। এই নায়িকাদের ব্যাপারেও দর্শকদের অভিযোগের কমতি নেই। প্রত্যেক নাটকেই কেন একজন নায়িকাকে অভিনয় করতে হবে। এখনকার টিভি নায়িকারা এত বেশি নাটকে অভিনয় করেন যে, কোন নাটকের নাম কী, কোন চরিত্রে অভিনয় করছেন কিংবা চরিত্রের ভবিষ্যৎ কী কোনো কিছুই তারা বলতে পারেন না। কেউ কেউ একই দিন তিন থেকে চারটি নাটকের সেটেও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। কীভাবে সম্ভব! হ্যাঁ, টিভি নায়িকাদের দিয়ে এটা সম্ভব। তারা মানের খোঁজ রাখেন না, শিল্পের প্রতি তাদের কোনো দরদ নেই। অথচ প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারে মুখ বড় করে বলে থাকেন, ‘কাজের ব্যাপারে আমি অনেক চুজি। বেছে বেছে কাজ করতে অনেক পছন্দ করি।’ এটা সত্যি যে, অপ্রয়োজনীয় ভিখারি কিংবা কাজের মেয়ের চরিত্রের প্রতিও তাদের দুর্বলতা রয়েছে। যে চরিত্রের কোনো ব্যাপ্তি নেই। নেই কোনো গভীরতা। সত্যি কথা হচ্ছে, অর্থ উপার্জনই নায়িকাদের কাছে মুখ্য।  টেলিভিশনে যেসব গ্ল্যামারাস মেয়ে অভিনয় করেন তারা সব সময় মুখিয়ে থাকেন কখন সিনেমা থেকে ডাক আসবে। অভিনয় যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক। সিনেমা করা চাই-ই-চাই। একটি সিনেমায় যদি কোনোক্রমে সুযোগ মিলে যায় তাহলে নাটককে গুডবাই বলতে মোটেও দ্বিধা করেন না তারা। কিন্তু সেই সিনেমা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন আবার নাটকই হয় তাদের জীবনধারণের পাথেয়। নাটকের অভিনেত্রীরা সিনেমায় যাওয়াটাও নাটকে নায়িকা সংকটের অনেক কারণের মধ্যে একটি। সিনেমায় সফলতা না পেলেও তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন আরও একটি সুযোগের অপেক্ষায়। যদিও তা হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে নায়িকাদের অতিমাত্রার অর্থলোভও আরও একটি কারণ। অর্থের জন্য বেশি পরিমাণ নাটকে অভিনয়ের কারণে দর্শকরা তাদের দেখে ক্লান্ত এবং বিরক্ত। একসঙ্গে একাধিক নাটকে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের কারণে নিজের গ্রহণযোগ্যতাও হারিয়ে ফেলছেন নায়িকারা। নাটক নির্মাতারাও অসহায়ের মতো চ্যানেল কর্তৃপক্ষের চাপে, নায়িকা সংকটের কারণে এ মেয়েদের নিয়ে বাধ্য হয়ে কাজ করছেন। অথচ এ টিভি নায়িকারা একবারও নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে চান না। দর্শকরা বিমুখ হবেন না কেন? দর্শকের প্রতি ভালোবাসার কথা মুখে খইয়ের মতো ফুটলেও আদপে টিভি নায়িকারা কখনই দর্শকের কথা ভাবেন না। নিজেদের ভাবনা এবং অর্থের মধ্যেই ডুবে থাকাই যেন তাদের নিত্যদিনকার রুটিন। টিভি নাটকে নায়িকা সংকটের জন্য টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি নায়িকারাও দায়ী বলে অনেকে বলেছেন। নির্মাতা ও অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাতাদের স্বাধীনতা থাকে না। নাটক এ সময়ে চলে গেছে এজেন্সিগুলোর হাতে। তারা শিল্পী নির্বাচন করে দেয়। নাটকের গল্প কাকে চায় তা না দেখে তাদের পছন্দের শিল্পীদের দিয়ে নাটক নির্মাণ করলেই তারা সন্তুষ্ট। ফলে দর্শকও সারা বছর একই মুখ দেখতে পায় নাটকে। নাটকে নতুন মুখ তৈরি করার জন্য নির্মাতাদের স্বাধীনতা দিতে হবে। তাহলে দর্শক ঘুরে-ফিরে একই মুখ দেখা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।’ নির্মাতা সাগর জাহান বলেন, ‘এটা সত্য নাটকে একই শিল্পীর বারবার উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাজেট সংকটের কারণে নির্মাতারা নতুনদের নিয়ে ঝুঁকি নিতে চান না। নতুন শিল্পী তৈরির জন্য নির্মাতাদের ঝুঁকি নিতে হবে। এটি নাটক এজেন্সির হাতে চলে যাওয়ায় সেই সুযোগ আরও কমে গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর