বিশ্বে সংগীতের ভাষা একটিই। সংগীতকে কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দী রাখা অসম্ভব। এক দেশের শিল্পী অন্য দেশে গাইবেন এটিই সংগীতের সর্বজনীনতা। বাংলাদেশের শিল্পীরাও শুধু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নয়, বলিউড সিনেমায়ও গেয়েছেন। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের মেয়ে কণ্ঠশিল্পী গীতা দত্ত থেকে বর্তমানের নগরবাউল জেমস মাতিয়েছেন বলিউড। এমন কিছু শিল্পীর হিন্দি সিনেমায় গান গাওয়ার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
গীতা দত্ত
১৯৪২ সালে কিশোরী বয়সেই মা-বাবার সঙ্গে ভারতের বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান বাংলাদেশের ফরিদপুরের রাজপরিবারের মেয়ে গীতা দত্ত। আসল নাম গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী। পরে ১৯৫১ সালে গুরু দত্তের ‘বাজি’ সিনেমায় গাইতে গিয়ে প্রণয়ে জড়ান গীতা। পরে গুরুকে বিয়ে করে গীতা রায় হয়ে ওঠেন গীতা দত্ত। বোম্বে যাওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বলিউড সিনেমায় গান গেয়ে জানান দেন নিজেকে। মাত্র ১২ বছর বয়সে সুরকার হনুমান প্রসাদ গীতার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ১৯৪৬ সালে তাঁর ‘ভক্ত প্রহলাদ’ নামের চলচ্চিত্রে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ দেন। অসাধারণ গায়কির কারণে পরের বছরে গীতা ‘দো ভাই’ ছবিতে প্লেব্যাক করেন। এই ছবিতে তাঁর গান প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রথমদিকে ভজন এবং দুঃখের গান গাইলেও ১৯৫১ সালে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে ‘বাজি’, ‘দেবদাস’, ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ সিনেমার গানগুলোর জন্য আজও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলিউড। তাঁর উল্লেখযোগ্য হিন্দি গানের মধ্যে রয়েছে- বাবুজি ধীরে চলনা ‘আর পার’, মেরা নাম চিন চিন চু ‘হাওড়া ব্রিজ’, আন মিলো আন মিলো, সহশিল্পী মান্না দে ‘দেবদাস’, মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া ‘দো ভাই’ ও সপনেবালি রাত ‘পিয়ার’, তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির ‘বাজি’, বক্ত নে কিয়া কেয়া হাসিন সিতম ‘কাগজ কে ফুল’, থান্ডি হাওয়া কালি ঘটা : ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ’, জব বাদল লেহরায়া ‘ছুমন্তর’, হাওয়া ধীরে আনা ‘সুজাতা’ আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগালো পেয়াসা,
মেরে জিন্দেগি কে হামসফর ‘শ্রীমতী ৪২০’।
মিতালী মুখার্জি
ভারতের গজলশিল্পী ভূপিন্দর সিংকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছেন বাংলাদেশি সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জি। ১৯৮৭ সালে মিতালী প্রথম হিন্দি সিনেমায় নাম লেখান। বাঙালি সংগীত পরিচালক বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে রিলিজ পাওয়া রাজএন সিপ্পির পরিচালনায় ‘সত্যমে জয়তে’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করা ‘তু জান সে পেয়ারা হ্যায়’ গানটিই মিতালী মুখার্জির একমাত্র হিন্দি ফিল্মের গান।
রুনা লায়লা
১৯৭৬ সালে বলিউডপাড়ায় নাম লেখান ভার্সেটাইল শিল্পী রুনা লায়লা। শুরুটা হিন্দি গানের বিখ্যাত সংগীত জুটি কল্যাণজি-আনন্দজির ‘এক সে ব্যারকের এক’ সিনেমার শিরোনামের আইটেম গান করা। ‘ঘরোন্দা’ সিনেমায় ভূপিন্দর সিংয়ের সঙ্গে ‘দো দিওয়ানে শেহের মে’ গানের জন্য রুনা লায়লা ফিল্ম ফেয়ার ম্যাগাজিনের বেস্ট প্লেব্যাক সিঙ্গারের নমিনেশন লাভ করেন। বিখ্যাত শিল্পী মোহাম্মদ রফির সঙ্গে ‘জান-ই-বাহার’ সিনেমার ‘মার গায়ো রে’ ডুয়েট গানটি করেন। রুনা লায়লা বিশ্বের প্রায় ১৭টি ভাষায় গান করে বালাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। এর মধ্যে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পস্তু, বালুচি, আরাবিক, ফার্সি, মালে, নেপালি, জাপানি, ইতালি, স্পেন, ফরাসি ও ইংলিশ অন্যতম। রুনা লায়লার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হিন্দি গান হলো-ইক সে বাড়কার ইক ‘ইক সে বাড়কার ইক’, তুমহে হো না হো ‘ঘরোন্দা’, মুঝে পেয়ার তুমসে নেহি ‘ঘরোন্দা’, দো দিওয়ানে শেহের মে, সহশিল্পী ভূপিন্দর সিং ‘ঘরোন্দা’ মার গায়ো রে, সহশিল্পী মোহাম্মদ রফি ‘জান-ই-বাহার’, আলীবাবা ‘অগ্নিপথ’ ম্যায় কালি আনার কি, ‘সাপনো কা মান্দির’ অ্যায় দিলওয়ালে আও ‘ইয়াদগার’, কাহো সাখি, : ‘ইক দিন বহু কা’।
এন্ড্রু কিশোর
১৯৮৬ সালে প্রমোদ চক্রবর্তীর পরিচালনায় আরডি বর্মণের সুরে হিন্দি ‘শত্রু’ সিনেমায় প্রথম গান করেন। সুপারহিট গায়ক কিশোর কুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গান করে সুনাম কুড়ান তিনি। যার বাংলা নাম ছিল ‘বিরোধ’। বিখ্যাত গীতিকার মাজরুহ সুলতানপুরির লেখা ‘সুরেজ চান্দা’, ‘মে তেরি বিসমিল হু’ হিন্দি গান দুটি গাওয়ার পাশাপাশি বাংলা ‘মুখে বল তুমি হ্যাঁ, ‘এর টুপি ওর মাথায়’ এবং ‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা’ গানগুলো করেন এন্ড্রু কিশোর। আর ‘এর টুপি ওর মাথায়’ বাংলা গানটির হিন্দি ভার্সন ‘ইসকি টুপি উসকি সার’ গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
জেমস
২০০৫ সালে বলিউডের সুরকার প্রীতমের সুরে ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় প্রথম কণ্ঠ দেন। প্রীতম কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ গানটির হিন্দি ভার্সন ‘ভিগি ভিগি রাতে’ গানটি করান জেমসকে দিয়ে ২০০৬ সালে, ‘ও লামহে’ ও ২০০৭ সালে ‘লাইফ ইন অ্যা মেট্রো’ সিনেমায় পর পর তিনটি গান রেকর্ড করান। ‘লাইফ ইন অ্যা মেট্রো’ সিনেমায় ‘আলবিদা’ ‘রিশতে’, ‘ওহ লামহে’ সিনেমার ‘চাল চালে আপনে ঘের’ এবং ২০১৩ সালে মিট ব্রস, অঞ্জনের ‘ওয়ার্নিং’ ছবির ‘বেবাসি’ গানটি বলিউডে এক সম্মানের জায়গায় আসীন করেছে জেমসকে, সঙ্গে বাংলাদেশকেও।