ঢাকার ছবির রয়েছে সোনালি অতীত। এখানকার ছবি একসময় দেশ-বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগাত। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেলেও এটি ঢাকার প্রথম ছবি নয়। ঢাকাই ছবিতে যা কিছু প্রথম এ প্রতিবেদনে সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
ছবি : দ্য লাস্ট কিস
১৯৩১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছিল ঢাকার প্রথম ছবি। এই ছবিটি ছিল নির্বাক। ছবিটি পরিচালনা করেন অম্বুজ গুপ্ত। এ ছবির দৃশ্যধারণ শুরু হয় ১৯২৯ সালে। ১৯৩১ সালে এটি মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে। এই সিনেমা হলে ছবিটি প্রায় এক মাস চলেছিল। ছবিটির একটি মাত্র প্রিন্ট তৈরি হয়। ছবির নায়ক ছিলেন খাজা আজমল আর নায়িকা লোলিটা ও চারুবালা। ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছিল ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি।
সবাক ছবি : মুখ ও মুখোশ
ঢাকার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’। ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করেন আবদুল জব্বার খান। এর কাহিনিও লিখেন তিনি। ১৯৫৪ সালে এই ছবির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার রূপমহল এবং চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে এটি মুক্তি পায়। এতে অভিনয় করেন আবদুল জব্বার, পূর্ণিমা সেন, জহরত আরা, পিয়ারি বেগম, আমিনুল হক, সাইফুদ্দিন, গওহর জামিল, ইনাম আহমেদ প্রমুখ।
নির্মাতা : অম্বুজ গুপ্ত
ঢাকাই ছবির প্রথম নির্মাতা ছিলেন অম্বুজ গুপ্ত। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘সুকুমারী’ ও পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য লাস্ট কিস’-এর নির্মাতা ছিলেন তিনি।
নায়ক : খাজা আজমল
ঢাকাই ছবির প্রথম নায়ক ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান খাজা আজমল। ‘লাস্ট কিস’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা লোক ছিলেন।
নায়িকা : লোলিটা
ঢাকাই ছবির প্রথম নায়িকা ছিলেন লোলিটা। তাঁর আসল নাম বুড়ি। ছবিতে তখন কোনো ভদ্রঘরের মেয়েকে অভিনয়ের জন্য পাওয়া যেত না বলে বাদামতলীর পতিতালয় থেকে বুড়িকে ‘লাস্ট কিস’ ছবির নায়িকা হিসেবে আনা হয়। নাম দেওয়া হয় লোলিটা। তাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর। লাস্ট কিস ছবির কাজ শেষ হওয়ার পর লোলিটা আবার তাঁর পূর্ব পেশায় ফিরে যান।
সিনেমা হল
পিকচার হাউস [শাবিস্তান], প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আরমেনিয়া স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম সিনেমা হল ‘পিকচার হাউস’। ১৯৫৬ সালে এই সিনেমা হলের মালিক হন মো. মোস্তফা। তিনি এর নাম বদলে রাখেন শাবিস্তান। হলিউডের গ্রেটা গার্বো অভিনীত একটি ছবি এখানে প্রথম প্রদর্শিত হয়।
সিনেমাস্কোপ ছবি
ঢাকার প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি হলো ‘বাহানা’। ১৯৬৫ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। উর্দু এই ছবিটি নির্মাণ করেন জহির রায়হান। এতে অভিনয় করেন রহমান, কবরী প্রমুখ।
রঙিন ছবি
সংগম (১৯৬৪, পরিচালক জহির রায়হান) ও স্বাধীন দেশে প্রথম রঙিন ছবি নির্মাণ হয় ১৯৭৫ সালে। ছবির শিরোনাম ‘বাদশা’। আকবর কবির পিন্টু নির্মাণ করেন ছবিটি। অভিনয় করেন খসরু, শাবানা, নূতন প্রমুখ। বাদশা দিয়েই শুরু হয় রঙিন ছবির যাত্রা।
মুক্তিযুদ্ধের ছবি
স্বাধীন দেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ হয় ১৯৭২ সালে। ‘ওরা ১১ জন’ শিরোনামের এই ছবিটি পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। আর প্রযোজনা করেন মাসুদ পারভেজ। এতে সত্যিকারের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়। ছবিটিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক, খসরু, শাবানা, নূতন, সুমিতা দেবী প্রমুখ। ব্যাপক সফলতা পায় ছবিটি।
আরও যা প্রথম...
♦ তথ্যচিত্র
ইন আওয়ার মিডস্ট (১৯৪৮)। এটি নির্মাণ করেন নাজীর আহমদ। দেশ বিভাগের পর নানা অস্থিরতা নিরসনে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা সফরে আসেন। এখানে তাঁর ১০ দিনের অবস্থানের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মী নাজীর আহমদকে। ইন আওয়ার মিডস্ট মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালের এপ্রিল-মে সময়ের মধ্যে। নাজীর আহমদ দেশীয় চলচ্চিত্রের বিকাশে ভূমিকা রাখেন।
♦ নারী চিত্রপরিচালক
রেবেকা। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী, লেখিকা ও পরিচালক। রাত্রি রায় ছদ্ম নামে প্রচুর ছবিতে অভিনয় করেছেন রেবেকা। তবে তাঁর প্রকৃত নাম মনজন আরা বেগম। ১৯৭০ সালে প্রথম কোনো মহিলা পরিচালক হিসেবে ঢাকাই চলচ্চিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ বছরই তিনি নির্মাণ করেন ‘বৃত্ত থেকে বিন্দু’ ছবিটি।
♦ নারী সংগীত পরিচালক
ফেরদৌসী রহমান (রাজধানীর বুকে ছবিতে যৌথভাবে রবিন ঘোষের সঙ্গে, ১৯৬০)
♦ চলচ্চিত্র পত্রিকা
মাসিক সিনেমা। প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে বগুড়া থেকে। সম্পাদক ছিলেন আবু তাহের মোহাম্মদ ফজলুল হক। এটি ২, এসি রায় রোড, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে।
♦ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন হয় ১৯৭৬ সালে। পুরস্কার প্রথম দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র থেকে। প্রথম সেরা ছবি ছিল লাঠিয়াল।
♦ আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি
জাগো হুয়া সাভেরা (উর্দু), মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৫৯। সুতরাং (বাংলা), ফ্রাঙ্কফুট এশীয় চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৬৫।
♦ শিশুতোষ চলচ্চিত্র
এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী। যা নির্মিত হয় ১৯৮০ সালে।
♦ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র
২০১৪ সালে নির্মাতা অমিত আশরাফ কাজ শুরু করেন অ্যানিমেশন ফিল্ম ‘ড্রিম স্টেইজ’ নিয়ে। যদিও পরবর্তীতে এর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
♦ বায়োস্কোপ প্রদর্শনী
১৭ এপ্রিল ১৮৮৯, ঢাকার ক্রাউন থিয়েটার।
♦ চলচ্চিত্র প্রদর্শক
মির্জা আবদুল কাদের সরকার, (লায়ন সিনেমা, ঢাকা)
♦ এফডিসিতে প্রথম ছবি
আসিয়া (৪ নভেম্বর ১৯৬০, পরিচালক ফতেহ লোহানী)।