শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
ফিরে দেখা : চলচ্চিত্র ২০২২

চলচ্চিত্রে পরাণে সঞ্চার সুদিনের হাওয়া

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রে পরাণে সঞ্চার সুদিনের হাওয়া

বছরজুড়ে বাংলা সিনেমাকে আলোচনায় রেখেছে পরাণ ও হাওয়া

২০২২ সাল। দেশীয় চলচ্চিত্রের হাওয়া বদলের বছর। পরাণে আশা জাগানিয়া সময়। এ বছরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৪৮টি ছবি। এর মধ্যে ‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’ ছবি দুটি রীতিমতো দেশ-বিদেশে পরাণের সঞ্চার করেছে আর স্বস্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে।

নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে নানা নেতিবাচক কারণে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পড়ে রাহুর কবলে। এ সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ও মানসম্মত ছবি নির্মাণ কমতে থাকে। ফলে দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে লোকসান গুনে বন্ধ হতে থাকে সিনেমা হল। সিনেমা হল শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়ায় বিনিয়োগ ফেরত না আসায় বন্ধ হওয়া শুরু হয় প্রযোজনা সংস্থা। এমনই চলমান অবস্থার মধ্যে ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দাঁড়ায়। ওই বছর দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বনিম্ন মাত্র ১৫টি ছবি মুক্তি পায়। তাও আবার দর্শক আনুকূল্য পায়নি। ২০২১ সালে ৩২টি ছবি মুক্তি পেলেও দর্শক সিংহভাগ ছবিই দেখেনি। এমন খরার মধ্যে কিছুটা স্বস্তির বৃষ্টি হয়ে এলো ২০২২ সাল। এ বছরে এখন পর্যন্ত ১২ মাসে ৪৮টি ছবি মুক্তি পেয়েছে এবং কয়েকটি ছবি দেশে-বিদেশে এতটাই সাড়া জাগিয়েছে যে, গত কয়েক বছরের ব্যর্থতার কষ্ট কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দিয়েছে। ভালো ছবি নির্মাণ হলে দর্শক যে দেখে আবার এই প্রমাণ পেয়ে অনেক নির্মাতা ছবি নির্মাণে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। শুরুতেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ টু’ ছবিটি দিয়ে সফলতার যাত্রা শুরু হয়। এরপর গলুই, শান, দিন দ্য ডে- দিয়ে যে দর্শক জোয়ার শুরু হয়েছিল; সেটাকে আরও কয়েক গুণ ত্বরান্বিত করে রায়হান রাফির ‘পরাণ’ ও মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’। বিশেষ করে চলতি বছর ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র জোয়ারে চাঙা হয়ে ওঠে ঢাকাই সিনেমা। আশায় বুক বাঁধেন প্রযোজক-পরিচালকরা। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, বিগত দুই বছরের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ২০২২ সাল। মুক্তি পাওয়া এসব ছবির মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িতদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সিনেমা হল, ওটিটি, দেশের বাইরে মুক্তি, টিভি স্বত্ব সব মিলিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি ছবি ছাড়া বেশির ভাগ ছবি থেকে লগ্নিকৃত অর্থই ফেরত আসেনি। তবে সেদিকে আপাতদৃষ্টি না দিয়ে ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র ব্লকবাস্টার হিট হওয়াকেই ইন্ডাস্ট্রির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন সবাই। করছেন উদযাপন। চলতি বছর ব্যবসায়িক সফলতার অঙ্ক ভালো না হলেও দর্শক ও সিনেবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছে বেশ কিছু ছবি। এর মধ্যে পাপ পুণ্য, শিমু, গুণিন, বিউটি সার্কাস, মুখোশ, অপারেশন সুন্দরবন, দামাল, দেশান্তর, কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া- বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেষ ছবিটি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও অন্য কয়েকটি দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মাননাও কুড়িয়েছে। চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায়- দর্শক কী ধরনের ছবি চায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে পারলে বাংলাদেশি ছবির আকাল যে সহসাই দূর হবে তার প্রমাণ মিলেছে এ বছর। অনেক বছর পর এ দেশের ছবি আবার দেশ-বিদেশে সাড়া জাগিয়েছে। এই সাফল্য ধরে রাখার দায়িত্ব চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংশ্লিষ্টদের। আশা করি আগামী বছর এই সফলতা আরও বাড়বে।

এদিকে চলতি বছরের গত শুক্রবার পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো হলো-

ছিটমহল, তোর মাঝেই আমার প্রেম, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২, মাফিয়া-১, মুখোশ, শিমু (মেইড ইন বাংলাদেশ), গুণিন, লকডাউন লাভ স্টোরি, জাল ছেঁড়ার সময়, গলুই, শান, বিদ্রোহী, বড্ড ভালোবাসি, পাপ পুণ্য, আগামীকাল, বিক্ষোভ, তালাশ, অমানুষ, পরাণ, দিন- দ্য ডে, সাইকো, কার্নিশ, যা হারিয়ে যায়, হাওয়া, আশীর্বাদ, ভাইয়ারে, লাইভ, বীরত্ব, অপারেশন সুন্দরবন, বিউটি সার্কাস, ঈশা খাঁ, হৃদিতা, যাও পাখি বলো তারে, রাগী, জীবন পাখি, বসন্ত বিকেল, রোহিঙ্গা, দামাল, কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, দেশান্তর, ভাঙন, মেইড ইন চিটাগং ও মাই লাভ, হডসনের বন্দুক, জয় বাংলা, ৭১-এর একখণ্ড ইতিহাস, পায়ের ছাপ এবং কাগজ।

এদিকে, ২০২২ সালে নানাভাবে আলোচনায় এসেছেন বেশ কয়েকজন নতুন নায়ক-নায়িকা। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয় দিয়ে চিত্রজগতে স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে নিয়েছেন কেউ, কেউবা আবার আগামী দিনের আশা জাগিয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন-

 

তরুণদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন শরিফুল রাজ, নাজিফা তুষি ও আদর আজাদ

শরিফুল রাজ

এ বছর সবচেয়ে আলোচিত নাম শরিফুল রাজ। তার অভিনয় জীবনের টার্নিং পয়েন্ট পরাণ। সিনেমাপ্রেমীরা একটিমাত্র সিনেমা দিয়ে চিনেছে রাজকে। ঢাকাই সিনেমায় এক বছরে একটি সিনেমা দিয়ে আগে এতটা আলোচনায় আসেননি কেউ। এখনো পরাণ সিনেমার প্রসঙ্গ এলেই রাজের নাম উচ্চারিত হয়। এ ছাড়া হাওয়া ও সর্বশেষ দামাল দিয়ে রাজ এ বছর হ্যাটট্রিক করেছেন। তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবছেন নির্মাতারা।

 

নাজিফা তুষি

রেদোয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু হলেও মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’য় অভিনয় করে দর্শক প্রশংসিত হন নাজিফা তুষি। সিনেমায় তিনি গুলতি চরিত্রে অভিনয় করেন। নাজিফা তুষি বলেন, মানুষের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। এই ভালোবাসার কারণে আনন্দ লাগছে, আবার ভয়ও লাগছে। নিজের ভিতর এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রায় ছয় মাস এই চরিত্রটি নিজের মধ্যে ধারণ করেছি। চরিত্র হয়ে ওঠার জন্য বেদে পল্লীতে গেছি। ওদের সঙ্গে থেকেছি। শুটিংয়ে এক মাস মোবাইল ফোন ব্যবহার করিনি। ছয় মাস ঠিকমতো ঘুমাইনি। এটি একটি রহস্যময় চরিত্র।

 

আদর আজাদ

বাংলা চলচ্চিত্রের এক সম্ভাবনাময় চিত্রনায়ক আদর আজাদ। সৈকত নাসির পরিচালিত ‘তালাশ’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথম সিনেমা দিয়েই নিজের দক্ষতা জানান দেন এই নায়ক। তার শুরুটা হয় মডেলিং দিয়ে। এরপর কাজ করেন নাটক-টেলিফিল্মে। নাটকে কাজ করলেও আদরের স্বপ্নজুড়ে ছিল শুধুই চলচ্চিত্র। তাই তো নাটকে দারুণ ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও আদর নিজেকে পুরোপুরি চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন। প্রথম সিনেমা মুক্তির আগেই হাফ ডজনেরও বেশি চলচ্চিত্রে কাজ করেন তিনি। ৭ অক্টোবর মুক্তি পায় আদর অভিনীত তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘যাও পাখি বলো তারে’। সিনেমার মজনু চরিত্রের আদরকে দর্শকরাও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে। তাকে নিয়ে এখন প্রযোজক ও নির্মাতারা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। আদরের ‘যাও পাখি বলো তারে’ দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ঢালিউডের গুণী নির্মাতা মালেক আফসারী। আদরের মধ্যে সম্ভাবনার প্রদীপ দেখতে পেয়েছেন তিনি।

সর্বশেষ খবর