সোমবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে জয়জয়কার

ফের ভিন্ন ধারার ছবির বাজিমাত

আলাউদ্দীন মাজিদ

ফের ভিন্ন ধারার ছবির বাজিমাত

নোনা জলের কাব্য

ফের ভিন্ন ধারার ছবির বাজিমাত হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে। ২০২১ সালের সেরা ছবির সম্মান পেল দুটি ছবি, আর এ দুটি ছবিই হলো ভিন্ন ধারার। সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কার পেতে যাচ্ছে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও ‘নোনা জলের কাব্য’। এ বছর ২৭ ক্যাটাগরিতে ৩৪টি পুরস্কার দেওয়া হবে। আর প্রতিটি ক্যাটাগরি জয় করে নিয়েছে ভিন্ন ধারার ছবি। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা যৌথভাবে মো. সিয়াম আহমেদ (মৃধা বনাম মৃধা) ও মীর সাব্বির মাহমুদ (রাতজাগা ফুল), অভিনেত্রী যৌথভাবে আজমেরী হক বাঁধন (রেহানা মরিয়ম নূর) ও তাসনোভা তামান্না (নোনাজলের কাব্য), অভিনেতা পার্শ্বচরিত্রে এম ফজলুর রহমান বাবু (নোনাজলের কাব্য), অভিনেত্রী পার্শ্বচরিত্রে শম্পা রেজা (পদ্মপুরাণ), অভিনেতা খলচরিত্রে মো. আবদুল মান্নান জয়রাজ (লাল মোরগের ঝুঁটি)। অভিনেতা কৌতুক চরিত্রে প্রভাষ কুমার ভট্টাচার্য মিলন (মৃধা বনাম মৃধা), শিশুশিল্পী আফিয়া তাবাসসুম (রেহানা মরিয়ম নূর), শিশুশিল্পী শাখায় বিশেষ পুরস্কার জান্নাতুল মাওয়া ঝিলিক (যা হারিয়ে যায়)। সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম (যৈবতী কন্যার মন), গায়ক কে. এম. আবদুল্লাহ-আল-মুর্তজা মুহিন (শোনাতে এসেছি আজ-পদ্মপুরাণ), গায়িকা চন্দনা মজুমদার (দেখলে ছবি পাগল হবি-পদ্মপুরাণ), গীতিকার প্রয়াত গাজী মাজহারুল আনোয়ার (অন্তরে অন্তর জ্বালা-যৈবতী কন্যার মন), সুরকার সুজেয় শ্যাম (অন্তরে অন্তর জ্বালা-যৈবতী কন্যার মন)। কাহিনিকার রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত (নোনাজলের কাব্য), চিত্রনাট্যকার নূরুল আলম আতিক (লাল মোরগের ঝুঁটি), সংলাপ রচয়িতা তৌকীর আহমেদ (স্ফুলিঙ্গ)। সম্পাদক সামির আহমেদ (লাল মোরগের ঝুঁঁটি), শিল্প নির্দেশক শিহাব নূরুন নবী (নোনাজলের কাব্য), চিত্রগ্রাহক দলগত-সৈয়দ কাশেফ শাহবাজি, সুমন কুমার সরকার, মাজহারুল ইসলাম রাজু (লাল মোরগের ঝুঁটি), শব্দগ্রাহক শৈব তালুকদার (রেহানা মরিয়ম নূর), পোশাক ও সাজসজ্জা ইদিলা কাছরিন ফরিদ (নোনাজলের কাব্য)। মেক-আপম্যান দলগত-মো. ফারুখ, মো. ফরহাদ রেজা মিলন (লাল মোরগের ঝুঁটি)। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আকা রেজা গালিব (ধর), প্রামাণ্য চলচ্চিত্র কাওসার চৌধুরী (বধ্যভূমিতে একদিন)। এদিকে বিদেশি নানা চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রতিবছর বাংলাদেশের ভিন্নধারার ছবিই সম্মানিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে বাংলাদেশের ‘কুড়া পক্ষীর শূূন্যে উড়া’ ছবিটি। নব্বই দশকের শুরু থেকেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভিন্ন ধারার ছবিই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে আসছে। চলচ্চিত্র বোদ্ধা অনুপম হায়াতের মতে, সময়ের পথে হেঁটে নতুনদের কাঁধে ভর করে এ বদলের হাওয়া লেগেছে। দর্শকদৃষ্টি আকর্ষণ, জাতীয় পুরস্কার অর্জন ও আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রশংসা এবং সম্মাননায় এগিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন ধারার ছবি। নব্বই দশকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া এই চিত্র এখনো অব্যাহত আছে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাসুদ পথিকের মতে, উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে জীবনের গল্প নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে মৌলিক ও জীবনধর্মী গল্পের অভাব নেই। দর্শক চলচ্চিত্রে নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখতে চায়। আয়নায় নিজের চেহারা দেখার মতো যখন ছবিতে নিজেদের চিরচেনা জীবনচিত্র খুঁজে পায় তখনই তারা সেই ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং ছবিটি সফল ও রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়। এসব ছবিতে থাকে নিজ দেশের কৃষ্টি ও কালচারের জয়গান। আর এমন গল্পের ছবি বদলে দিচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্রকে। ১৯৯২ সালে নতুন ধারার গল্পের ছবি ‘শঙ্খনীল কারাগার’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবির মর্যাদা লাভ করে। এরপর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে সর্বশেষ ঘোষিত ২০২১ সালের জাতীয় পুরস্কারে সেরা ছবি ও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভিন্ন ধারার গল্পের ছবিই সেরার মর্যাদা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশে প্রথম ভিন্ন ধারায় নির্মিত ছবি ‘আগামী’ নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। এটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। ছবিটি সব শ্রেণির দর্শকের নজর কাড়ে। এরপর এ ধারার চলচ্চিত্রের সুদিন শুরু হয়। জুনায়েদ হালিম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, আবু সাইয়্যিদ, তারেক শাহরিয়ার, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি, মানজারে হাসান মুরাদ, নূরুল আলম আতিক, জাহিদুর রহমান অঞ্জন, সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড, অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সৈয়দা নিগার বানুর মতো নির্মাতারা এগিয়ে আসেন ভিন্ন ধারার গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে। তাদের হাতে এমন গল্পের ছবি সমৃদ্ধ হয়। গড়ে ওঠে ‘প্যারালাল সিনে মুভমেন্ট’ শিরোনামের একটি সংগঠন। পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক প্রশংসায় ভিন্নধারার ছবি সিক্ত হয়। দর্শক আগ্রহ বদলে দেয়। কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের ভিন্নধারার চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি তৈরি করেছেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি স্ক্রিন’-এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।’ এতে বলা হয়, বাংলাদেশের কিছু নির্মাতা ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলছেন। দিনবদলের আলো জ্বালাতে শুরু করেছেন।  প্রতিবেদনে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দিন বদলের হাতিয়ার এখন তাদেরই হাতে।

সর্বশেষ খবর