বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

রুচির দুর্ভিক্ষে সামাজিক বিনোদন

রুচির দুর্ভিক্ষে সামাজিক বিনোদন

সম্প্রতি নাট্যজন মামুনুর রশীদের করা মন্তব্য ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। হিরো আলমের মতো কনটেন্ট ক্রিয়েটরের উত্থান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।  সত্যি কী রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে? এ নিয়ে কথা বলেছেন শোবিজ জগতের বিশিষ্টজনরা।  তাঁদের বলা কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও পান্থ আফজাল

 

সোহেল রানা

মামুনুর রশীদ সাহেবের কথার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ তিনি যদি শুধু হিরো আলমকে উদ্দেশ করে বলতেন তাতেও আমার দ্বিমত থাকত। আবার যদি আমাদের বিনোদন জগতের রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলতেন তাতেও আমি একমত হতাম না। তিনি হিরো আলমের উত্থান বলতে গিয়ে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা ঠিক নয়। আমি বলব একটি ছেলে নিজের যোগ্যতায় আজ নিজের একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। সে স্বীকার করেছে তার শিক্ষা, চেহারা ভালো নয়। সে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না। এটি কী রুচির দুর্ভিক্ষ? শুধু বিনোদন জগৎ নয়, তার সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়েও কথা উঠেছে। কিন্তু কেন, সে তো এই দেশের একজন নাগরিক। নাগরিক হিসেবে তার তো নির্বাচন করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। সে তো ফৌজদারি মামলার আসামি নয় যে, সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। মামুনুর রশীদ সাহেব যদি হিরো আলমের অরুচিকর নাচ-গানের মিউজিক ভিডিওর কথা বলতেন তাহলে তা আমি সমর্থন করতাম। হিরো আলমের বেলায় রুচির প্রশ্ন তুললে আমি জানতে চাইব দেশের উন্নতি কোথায় হয়েছে? যা হয়েছে চাক্ষুষ হয়েছে, যেমন দালানকোঠা, ফ্লাইওভার, ব্রিজ ইত্যাদি। কিন্তু মানুষের মনের উন্নতি কী হয়েছে? আমাদের আচার-আচরণ, নীতি-আদর্শ, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই তো রুচির দুর্ভিক্ষে ভরা। বায়ান্নোতে ভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে সেই জাতি এখনো ফ্যাশন করে ইংরেজিতে কথা বলে। এখনো স্টাইল করে স্যুট-টাই পরে। আমার কথা হলো হিরো আলম যদি রুচির দুর্ভিক্ষের উদাহরণ হয় তাহলে আমাদের রাজনীতি ও বিনোদন দুনিয়ায় যে রুচির অবক্ষয় চলছে তাকে কী বলব। আমাদের নাটক-সিনেমায় এখন ছোট কাপড়, অশ্লীল সংলাপ আর গান কী রুচির দুর্ভিক্ষ নয়? এসব নিয়ে কেন কথা বলা হয় না। আমি বলব অন্যসব শিক্ষিত মানুষের তুলনায় হিরো আলমের যে সাহস ও মেধা রয়েছে তাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করতে হয়। যেমন- আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করার ব্যাপারে সে বলেছে আরাভ খানের কৃতকর্মের বিষয়ে আমাদের তো প্রশাসন কিছু বলেনি। তার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ রয়েছেই তখন আমাদের এয়ারপোর্ট থেকেই কেন ফিরিয়ে দেওয়া হলো না। হিরো আলম আরও বলেছে, আমরা তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে গিয়েছি বলেই পুলিশ তাকে খুঁজে পেয়েছে। কোথায় সাকিব আল হাসান তো সাহস করে এভাবে মুখ খোলেননি। হিরো আলম তো বিদেশি ভাষায় কথা বলছে না। সে এই দেশের একটি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। এটি কী কোনো অপরাধ? অনেক শিক্ষিত মানুষ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না। এটি কোনো অপরাধ নয়। আসলে আমাদের নৈতিকতা সব ক্ষেত্রেই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। নীতি-আদর্শ, সততা এখন কোথায়? এ অবস্থায় চেহারা সুন্দর নয় এবং শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না বলে হিরো আলমের উত্থানকে বিনোদন জগতে রুচির দুর্ভিক্ষ বলা অবান্তর। কারণ শুধু আমাদের দেশ নয়, বিদেশেও অনেক অসুন্দর ও অশিক্ষিত মানুষ নিজের দক্ষতায় একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়ে পরে নিজের এসব অভাব পূরণ করে নিয়েছে। তাই কারও চেহারা আর শিক্ষা নয়, তার মেধা ও সাহসকে মূল্যায়ন করতে হবে।

 

মামুনুর রশীদ

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, এই রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য আমরাও দায়ী। হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই দায়ী। কিন্তু যারা অভিযুক্ত করছেন, তারা জানেন না, আমরা যারা ৫০ বছর ধরে নাটক করছি, তারা কী কষ্ট করে রাতের পর রাত নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রক্ত-ঘাম করে থিয়েটার করেছি। আসলে নাট্য সংস্কৃতির মধ্যে শুধু নাটকের লোক নয়, আমরা দর্শককেও রুচিবান করতে পারিনি। রুচির দুর্ভিক্ষ দর্শকের মধ্যেও হচ্ছে। তারা এখন যেসব নাটক বা অনুষ্ঠান পছন্দ করছে, আমরা সেই বিষয়গুলো কল্পনাও করিনি বা ভাবিনি। নাট্য সংস্কৃতির বিষয়টিকে এখন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীটা এত বিধ্বস্ত, এত বিভক্ত। আমাদের সমাজ এত বিভক্ত, আমাদের রাজনীতি এত বিভক্ত।

 

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্যাপক পরিসরে বলতে হবে। সংকীর্ণ স্থানের কারণে শুধু এতটুকু বলব, আসলে রুচি হলো আপেক্ষিক। নানা শ্রেণির কাছে নানারকম। আমার চোখে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সকলে সমান’। তাই বলে এই নয় যে, একটি লেজ লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। তবে আমার কথায় সব চলবে না। তবুও বলব ব্যক্তিগত রুচি আমার নিজের। কিন্তু অন্যের বেলায় কেন কথা বলতে যাব। আমি একজন আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির মানুষ বলে আমার নিজস্ব কিছু রুচি ও সংস্কৃতি রয়েছে। তবে হুট করে কাউকে আমি বিকৃত রুচির মানুষ বলতে রাজি নই। সেই অধিকারও আমার নেই। তবে আমার শেষ কথা হলো, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাঙালি সত্তার উদ্ভব ঘটেছে সেই বাঙালি সত্তা ও রুচির ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যে সংস্কৃতি আছে তাতে রুচিশীলতার একটি ইঙ্গিত আছে। আমাদের বঙ্গবন্ধু যখন পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিবকোট পরে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে দাঁড়াতেন তখন তাঁকে কোনো অংশে খাটো মনে হয়নি, বরং বড় মনে হয়েছে। তাই নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চাটিই আমাদের নিজস্ব রুচির ধারকবাহক বলে আমি মনে করি।

 

সারা যাকের

‘এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে, এর মধ্য দিয়েই হিরো আলমের উত্থান হয়েছে’- মামুনুর রশীদ ভাইয়ের এই কথার সঙ্গে আমিও একমত। মানুষ যা খুশি তাই নিয়ে হইচই করছে, যে কোনো বিষয় নিয়েই মন্তব্য করছে। কিন্তু মানবাধিকার প্রশ্নে কেউ কোনো মন্তব্য করছে না। মানবাধিকার প্রশ্নে বলা হচ্ছে, এটা ঠিক নয় বা হচ্ছে না-সেটা নিয়ে কেউ কি তেমন করে আওয়াজ তুলেছে? এখন এসব কারণে কুরুচি, অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান হয়েছে। রুচির দুর্ভিক্ষ-এই জিনিসটা তো হয়েছে, তাই নয়? আমি খুব খুশি হয়েছি মামুন ভাইয়ের এমন বক্তব্যে। কথাগুলো তো একদম সত্যি।

 

শমী কায়সার

রুচির দুর্ভিক্ষে সামাজিক বিনোদন কথাটা ঠিকই। সংস্কৃতির পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর অবদানসহ প্রত্যেকটি বিষয়ে আমরা না জেনেই কাজ করছি। আমাদের রয়েছে সংস্কৃতির বিশাল ভান্ডার। কিন্তু আমরা এটিকে ধারণ করছি না। ফলে সংস্কৃতির জায়গা থেকে আমরা অনেকাংশেই সরে গেছি। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেই জায়গায় আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা যদি না থাকে তাহলে তো রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দেবেই। যিনি বলেছেন তিনি ঠিকই বলেছেন।

 

শুভ্রদেব

এটা আসলে নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষের মানসিকতার ওপর। তবে কিছু বিষয়কে ইগনোর করলে বেটার। আমি যদি মনে করি, এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক মনন ও মেধা থাকলে যে কেউ সেটা ইগনোর করতে পারবে। আরেকদিকে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব তো থাকেই। নব্বইয়ের আগে থেকেই আমরা সংস্কৃতি চর্চা শুরু করেছি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান দেখেছি। দীর্ঘ জীবনে অনেক সাংস্কৃতিক পালাবদল দেখেছি। সে সময় তো কোনো অপসংস্কৃতিকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যে কেউ ইচ্ছা করলেই কুরুচিপূর্ণ বিষয়  দেখতে পারত না। এখন তো সেলফোনে সবকিছু ঢুকে গেছে। ইচ্ছা করলে সহজেই দেখতে পারে। এগুলো রেসটিকটেড করার অপশন তো আছে! তবে রুচি কিন্তু একটি পরিবারের কালচার ও শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। সেটা হাতেগোনা কিছু মানুষ এখনো প্র্যাকটিস করে।

সর্বশেষ খবর