বছরদুয়েক আগে কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের তরুণ ও নতুন চলচ্চিত্রনির্মাতা ও তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে পত্রিকায় প্রতিবেদন ছেপেছিল। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য যে কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ ও নতুন নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি তৈরি করেছেন।’ পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি স্ক্রিন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল- ‘বাংলা চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্মাতারা এখন ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলছে। এটা ওই দেশের সিনেমার জন্য শুভ লক্ষণ। তাই দীর্ঘদিন পর ভালো গল্পের ছবি পেয়ে সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছে দর্শক।’ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায়- ‘চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের ছবি, যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এ জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। এ নতুন নির্মাতাদের হাত ধরেই চলচ্চিত্রের পালে আবার সুবাতাস বইতে শুরু করেছে।’ সর্বশেষ গত ঈদে মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফি পরিচালিত ‘তুফান’ ছবিটি এ স্বস্তির হাওয়াকে যেন আরও ত্বরান্বিত করেছে। ছবিটি দেখতে দর্শক সিনেমা হলগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। টিকিট না পেয়ে হলে ভাঙচুরের খবরও পাওয়া গেছে। ঢাকার মধুমিতা সিনেমা হলে ভাঙচুর চালিয়েছেন বিক্ষুব্ধ দর্শক। টিকিটের জন্য সিনেমা হলে এমন উন্মাদনা দেখা যেত আশির দশক পর্যন্ত। এখানেই তুফান উন্মাদনার শেষ নয়, স্টার সিনেপ্লেক্সের দুই দশকের ইতিহাসে বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ শোর রেকর্ড গড়েছিল ‘তুফান’। শোর হিসাবে এর আগের প্রিয়তমা, পরাণ ও হাওয়া সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে তুফান। তার আগে গত ২০২২ সালে করোনা মহামারির পর থেকে মুক্তি পাওয়া অধিকাংশ ছবির নির্মাতাই ছিলেন তরুণ ও নবীন। যেমন দেবাশীষ বিশ্বাসের ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-টু’, হিমেল আশরাফের ‘রাজকুমার’ ও ‘প্রিয়তমা’, মেসবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’, রায়হান রাফির ‘পরাণ’, ‘তুফান’, ‘সুড়ঙ্গ’, কামরুজ্জামান রুমানের ‘মোনা জ্বীন-টু’ ও ‘লিপিস্টিক’, এস এ হক অলিকের ‘গলুই’, তপু খানের ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’, হৃদি হকের ‘৭১ এর সেইসব দিন’, এম এ রহিমের ‘শান’ প্রভৃতি। ২০২২ সালের শুরুতে দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-টু’ ছবিটি দিয়ে এ সফলতার যাত্রা শুরু হয়। ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ ও ‘গলুই’ দিয়ে দেশীয় সিনেমা ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পায়। এরপর ওই বছরের ঈদুল আজহায় ঢাকাই সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ঈদের ছবি ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ দেখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে ভিড় করতে থাকে দর্শক। মুক্তির পর ‘হাওয়া’ ছবিটি তৈরি করে বাংলা সিনেমার নতুন রেকর্ড। কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বহুল আলোচিত একটি হলিউডি ছবির প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়। ‘হাওয়া’ ছবিটি দেশের দর্শকের হৃদয় জয়ের পর উত্তর আমেরিকায় মুক্তি পায় এবং সেখানেও সাড়া জাগায়। কলকাতায় মুক্তি পেয়েও দর্শকনন্দিত হয়। ২০২৩ সালে আবারও নতুন নির্মাতারা তাদের মুিন্সয়ানা দেখান। ওই বছরের ঈদে মুক্তি পাওয়া প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ ছবিগুলোর প্রতি দর্শক আগ্রহ তাই বলেছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রনির্মাতা ছটকু আহমেদ বলেন, ‘সময়ের পথে হেঁটে নতুনত্বের কাঁধে ভর করে এ সুদিনের হাওয়া লেগেছে। উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে নতুনরা জীবনের গল্প নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ করছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।’ চলচ্চিত্র ‘১৯৭১ সেইসব দিন’। হৃদি হক তাঁর এই প্রথম চলচ্চিত্রে খুব সাবলীলভাবে একটি ধারা বর্ণনায় দুটি লাইন বলেছেন। যা এ ছবি ও সাম্প্রতিক বোধের দুনিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথায় ‘আমরা নিরপেক্ষ থাকার আড়ালে কিছু বিষয় প্রশ্রয় দিই বা কিছু অনৈতিকতাকেও সমর্থন করি।’ হৃদি হকের চলচ্চিত্রের গল্প ও গল্পের বয়ান দর্শকমন ছুঁয়েছে বলেই দর্শক মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখেছে। ওই বছরে ‘গলুই’, ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র জোয়ারে চাঙা হয়ে ওঠে ঢাকাই সিনেমা। আশায় বুক বাঁধেন পরিচালক প্রযোজকরা। পরের বছরও ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’ ছবিগুলো ভিন্নধর্মী গল্পের কারণে সফলতা দেখিয়েছে। এরপর ‘রাজকুমার’ এবং ‘তুফান’ ছবি দুটি দেশীয় চলচ্চিত্রের সফলতার জোয়ারকে বেগবান করে তুলে। বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন নির্মাতাদের হাত ধরে বেশ কয়েকটি ছবিতে জীবনবোধের গল্প ওঠে আসা এবং দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড বলেন, ‘বদলে যাচ্ছে ঢাকাই সিনেমার গল্প। সময়ের পথে হেঁটে নতুন নির্মাতাদের হাতে নির্মিত নতুন গল্পের ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দর্শক। এ নতুন ধারার গল্পের ছবির দর্শকপ্রিয়তা ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি এখনো অব্যাহত আছে।’ নতুন নির্মাতা রায়হান রাফি বলেন, ‘দর্শক যেহেতু বাস্তবধর্মী ও সমসাময়িক গল্পের ছবি দেখতে চায়, যে ছবিটি দেখে তারা ভাববে ‘আমরাতো মনে মনে এই গল্পটির কথাই ভেবেছিলাম। সুতরাং আমরা সেরকম গল্পের ছবিই নির্মাণ করতে চাই।’ আরেক তরুণ নির্মাতা তপু খান বলেন, ‘দর্শক আসলে এখন চলচ্চিত্রে তাদের চিন্তা-চেতনা ও মননের প্রতিফলন দেখতে চায়। তাদের মৌলিক অধিকারের কথা গল্পে চায়। এর মধ্যে প্রেম ভালোবাসা, রাজনীতি, প্রতিবাদ- সবই থাকতে পারে।’ নবীন চিত্রনির্মাতা হিমেল আশরাফ বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে গল্পের সিনেমা বানাতে পছন্দ করি। কারণ দর্শক গল্পের সিনেমাই চায়। সুলতানা বিবিয়ানা, প্রিয়তমা কিংবা এই রাজকুমার, সবই গল্পনির্ভর সিনেমা। আমার প্রধান টার্গেট দর্শক মধ্যবিত্ত, যারাই আসলে আমাদের বড় অংশ, এর মধ্যে ফ্যামিলি দর্শক আমার প্রধান নিশানা। তবে আমি চেষ্টা করি সব ধরনের দর্শকের পছন্দের কিছু রাখতে। কারণ দর্শক কিন্তু টাকা দিয়ে আমাদের সিনেমা দেখবে।