বিটিভির ওপর থেকে দর্শক আশা হারিয়েছেন অনেক আগেই। ভরসা ছিল শুধু স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর। কিন্তু এখন চ্যানেলে চলছে মানহীন অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। আর তাই দর্শক ধরে রাখতে পারছে না চ্যানেলগুলো। দিনে দিনে দর্শক হিন্দি অনুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে। ফলে বাড়ছে স্যাটেলাইট টিভির দৈন্য। নন-ফিকশন কিংবা রিয়েলিটি শোতে বাংলাদেশ কখনোই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না। একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল নাটক। এখন নাটক থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শক। মানহীন নাটক প্রচার হচ্ছে। ভালো নাটক হলেও বিজ্ঞাপনের অত্যাচার প্রকট হচ্ছে। আর নন-ফিকশন কিংবা রিয়েলিটি শোতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো করার চেষ্টা থাকলেও, মানহীন কিংবা গতানুগতিক অনুষ্ঠানই বেশি। সব মিলিয়ে দর্শক রিমোট চেপে ঝুঁকছে ভারতীয় চ্যানেলের দিকে।
ছোট একটা জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, মানুষ এখন দেখছে হাতেগোনা কিছু অনুষ্ঠান।
এর মধ্যে নন-ফিকশন কিংবা রিয়েলিটি শোর সংখ্যা একেবারেই কম। তবে লাইভ গানের অনুষ্ঠান দর্শক কম-বেশি দেখে। পাশাপাশি সেলিব্রেটি শোয়ের প্রতি দর্শকের আগ্রহ অল্প হলেও আছে। আর নাটকের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের অত্যাচার সহ্য করেও দর্শক এখনো হাতেগোনা অল্প কিছু নাটক উপভোগ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য_ 'অ-এর গল্প', 'ভালোবাসার চতুষ্কোণ', 'এলেবেলে', 'পরিবার করি কল্পনা', 'লঙ্গরখানা', 'মাগো তোমার জন্য', 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে', 'পাতালপুরীর রাজকন্যা' প্রভৃতি।
ছোট্ট এই হিসেবে থেকেই চ্যানেলগুলোর বর্তমান দৈন্য পরিষ্কার। অসংখ্য অনুষ্ঠানের ভিড়ে মানুষ কোনো কিছু না ভেবেই অল্প কিছু নাটকের নাম বলতে পারছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্র্রির প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ফুলে-ফেঁপে গেছে, তাই আমরা দর্শক হারাচ্ছি। যেখানে দেশে চ্যানেল থাকা উচিত ছিল সাত/আটটি সেখানে চ্যানেল ২৫টির ওপর। আরও আসছে। এসব হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে। ফলে একটা দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, চ্যানেল বাড়ছে, তাই বিজ্ঞাপন রেট কমছে। বিজ্ঞাপন রেট কমায় চ্যানেল বাজেট দিতে পারছে না, তাই ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ হচ্ছে না। ফলে দর্শক দেখছে না। দর্শক দেখছে না দেখে বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন কমিয়ে স্টার প্লাসে চলে যাচ্ছে। এই দুষ্ট চক্রের কারণে ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা আরও কাহিল হবে। আমরা দর্শক হারাব। আরও একটি বড় কারণ, চ্যানেল বেড়ে যাওয়ায় দক্ষ কর্মী কমছে।
বর্তমান পরিস্থিতি এবং উত্তরণ প্রসঙ্গে বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান শামীম শাহেদ বলেন, বিষয়টি সত্যি। একসঙ্গে প্রচুর চ্যানেল চলে আসায় একটা অসম এবং অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সব চ্যানেল একই সময়ে একই স্বাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে যাচ্ছে। পাশাপাশি চ্যানেলে মেধাবী সৃষ্টিশীল কর্মীর খুবই অভাব। আর আমাদের দেশের বেশির ভাগ চ্যানেলই আসে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তাই কর্তৃপক্ষ খবরের দিকে বেশি মনোযোগী, অনুষ্ঠানে কম। তারা মনে করেন অনুষ্ঠান করা কোনো ব্যাপার নয়। পরে ভিনদেশি অনুষ্ঠানের অনুকরণে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। এটা কোনো কৌশল হতে পারে না। আমার বিশ্বাস এ অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। পরিবর্তন হবে, হতেই হবে। আমরা বাংলাভিশন পরিবার বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছি। অনুষ্ঠান একেবারে চলমান প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে করছি। তাতে আমরা ফলও পাচ্ছি। সবসময় টিআরপি জরিপে আমাদের অনুষ্ঠান প্রথমে থাকে। তা ছাড়া আমরা ঈদে বিজ্ঞাপন বিরতিহীন নাটক প্রচার করেছি। কিছু চ্যানেল সেটা অনুকরণ করছে। আমার মনে হয়, তরুণ মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল কর্মী বাড়লেই অবস্থার পরিবর্তন হবে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং শামীম শাহেদের সঙ্গে যোগ করে নির্মাতা সালাউদ্দীন লাভলু বলেন, তিনটি কারণে আমরা দর্শক হারাচ্ছি। প্রথম কারণ বাজেট। ভালো নাটক নির্মাণ করতে যে বাজেট প্রয়োজন তা চ্যানেল দিচ্ছে না। এর পর ভালো গল্প এবং ভালো অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা একেবারেই কম। পাশাপাশি অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের চাপে দর্শক চ্যানেল পাল্টে দিচ্ছে। ফলে আমরা দর্শক হারাচ্ছি।
অভিনেতা ও নির্মাতা মাহফুজ আহমেদ বলেন, 'আসলে সমস্যা খুব গভীর। তবে আমি সমস্যা না, আশার কথা বলতে চাই। যদি আমাদের চ্যানেলগুলো ভালো নাটক নির্মাণ করে নিয়ম পরিবর্তন করে প্রচার করতে পারে, তবে দর্শক আসবে, দেখবে। চ্যানেল যদি ভাবে, আমার চ্যানেলে একটা বা দুটা স্পেশাল নাটক বা অনুষ্ঠান আছে। এখানে বিজ্ঞাপন খুব যাবে, যা যাবে হাই রেটে যাবে। তাহলেই কিন্তু দর্শক ধরে রাখা সম্ভব। আসলে একটি চ্যানেলেও স্পেশাল কোনো কিছু নেই। নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য স্পেশাল এবং এঙ্ক্লুসিভ কিছু রাখা উচিত, এগুলোই অন্য চ্যানেল থেকে নিজেদের আলাদা করবে এবং টিকিয়ে রাখবে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, শামীম শাহেদ, সালাউদ্দীন লাভলু এবং মাহফুজ আহমেদের কথায় এটা পরিষ্কার, চ্যানেলগুলোতে মানহীন অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। কিছু নির্দিষ্ট কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, চ্যানেল বেড়ে যাওয়ায় বিজ্ঞাপন রেট কমছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় অযথাই চ্যানেল বাড়ছে, মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল কর্মীর অভাব, গল্প-অভিনয়শিল্পী-বাজেটের অভাব এবং চ্যানেলগুলো এঙ্ক্লুসিভ অনুষ্ঠানের অভাব মানহীন অনুষ্ঠানের কারণ। সমস্যাগুলো সমাধানে দ্রুত চ্যানেলগুলো একাত্দ হতে পারলে ফিরবে বাংলাদেশের অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য।