আমি খুব ছোটবেলায় কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়েছি। তার ঘনিষ্ঠ শিষ্য চিত্ত রায় ও কমল দাশগুপ্তের কাছে সরাসরি গান শিখেছি। কবিকে গান শুনিয়েছি। আমাদের আন্তরিক চেষ্টা ছিল শুদ্ধভাবে নজরুলসংগীত প্রসার হোক। সেটা অনেকখানি হয়েছে। নজরুলের সব গানের স্বরলিপি প্রণীত না হওয়ায় কখনো কখনো সুর বিকৃতি হয়েছে। এর প্রতিরোধে নজরুল ইনস্টিটিউট নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। তারা নজরুলের রচনা নিয়ে গবেষণা, বই প্রকাশ, সিডি প্রকাশ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে নজরুলসংগীত সম্পর্কে জানার ভীষণ আগ্রহ। তারা নিষ্ঠার সঙ্গে শুদ্ধ নজরুলসংগীত শিখছে ও চর্চা করছে। মনে রাখতে হবে, কাজী নজরুল আমাদের বাঙালি জাতির গৌরব। এই গৌরব ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি নজরুলের রচনা তার গান শুদ্ধভাবে চর্চা করতে হবে। তিনি তার সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন।
অন্তত গত ১০ বছরের তুলনায় এ দেশে এখন নজরুলসংগীত চর্চা সমৃদ্ধ হয়েছে। কারণ নতুনরা ব্যাপকহারে আগ্রহ নিয়ে শিখতে আসছে। ছায়ানটে ভালো শিল্পী তৈরি হচ্ছে। নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদে বর্তমানে দুইশ'রও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা সত্যিকার অর্থে নজরুলচর্চায় নিমগ্ন রয়েছে। ঢাকার বাইরেও একই চিত্র। তবে এ দেশে নজরুলসংগীত চর্চাকে যথার্থ করতে অনেক কিছুই করণীয় রয়ে গেছে। যেমন- আগের দিনের রেকর্ড থেকে প্রকৃত সুর অনুসরণ করে চর্চা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের শাস্ত্রীয় সংগীত শেখার প্রতি মনোযোগী হতে হবে, সত্যিকারের গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হবে এবং প্রতিষ্ঠা পেতে হলে যথাযথভাবে সাধনা করতে হবে। তা ছাড়া টিভি চ্যানেলগুলোকে বিশেষ দিবসে শুধু পুরনো শিল্পী-নির্ভর হয়ে থাকলে চলবে না। নতুনদেরও সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দেবে।
বাংলাদেশে নজরুলসংগীত চর্চা এখন অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীরা আসছে এবং আশাতীত ভালো ফল করছে। যেহেতু এখন নজরুলসংগীত চর্চা প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, তাই সরকারি সহযোগিতাও তারা ভালো পাচ্ছে। তাই বলা যায় বর্তমানে সঠিক চর্চা বেড়েছে এবং দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই আমার দেখা মতে নজরুলসংগীত চর্চার প্রতি এ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে এবং তারা যথাযথভাবে শিখতে চাচ্ছে। তবে দেশে নজরুলচর্চা আরও বাড়াতে এবং সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ করতে সরকারি এবং ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো দরকার। যেমন মফস্বল শহরগুলোতে কর্মশালা, প্রচার এবং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে অডিও সংস্থাগুলোরও এক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
অনেকে নজরুলসংগীত চর্চা করছেন। নজরুলের গানে যে বৈচিত্র্য তা হৃদয়ে ধারণ করছেন। তবুও বলব, নজরুলচর্চা আরও বেশি হওয়া উচিত। এ কথা কিন্তু আমি হতাশা থেকে বলিনি, বলেছি প্রত্যাশা থেকে। এখন দেশে যেভাবে নজরুলচর্চা হচ্ছে, তা ঠিক আছে। নতুন প্রজন্মের প্রচুর ছেলেমেয়ে আসছে। তারা চর্চা করছে। অনেক ভালো শিল্পীও বের হচ্ছে। তবুও বলব, আরও বেশি মাত্রায় নজরুলচর্চা হওয়া উচিত। এটাই কবির জন্মদিনে আমার প্রত্যাশা। আর একটা কথা, নজরুলচর্চা মানে কিন্তু শুধু সংগীতচর্চা নয়, কবি যে বাণী দিয়ে গেছেন, তার অর্থ এবং অন্তর্নিহিত অর্থ আমাদের বুঝতে হবে। জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। কবির জীবনবোধ যদি আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে চর্চা করতে পারি, তবে জীবনও কিন্তু সুন্দর হবে। নতুন প্রজন্মকে বলব, তোমরা নজরুলে ডুবে থাক।
বাংলাদেশে নজরুলসংগীত চর্চা বর্তমানে খুবই আশাব্যঞ্জক। নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদের মাধ্যমে হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী এ বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে। নজরুলসংগীতের প্রতি তাদের এই আগ্রহ সত্যিই সিনিয়র শিল্পী ও নজরুল গবেষকদের আনন্দ দিচ্ছে। তবে নজরুলচর্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারিভাবে বৃত্তি চালু ও সিনিয়র শিল্পীদের জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলে সব শিক্ষার্থীর জন্য ব্যাপকহারে অংশগ্রহণ এবং সিনিয়র শিল্পীরা নজরুলসংগীত সম্পর্কে শিক্ষাদানে যথেষ্ট সময় পেতেন। অন্য একটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নজরুল অনুষ্ঠান প্রচারে টিভি চ্যানেলগুলোর কোনো ধ্যানধারণা নেই। আগে বিটিভি নজরুলসংগীত শিল্পী তৈরি করত আর এখন চ্যানেলগুলো সেই তৈরি শিল্পী নিয়েই কাজ করছে। নতুন শিল্পী তৈরিতে তাদের কোনো ভূমিকা বা উদ্যোগ নেই। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত।