অপুর দোরগোড়ায় সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাতে নির্মাতাদের দীর্ঘ লাইন। কাজের চাপে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাওয়া। টের পেলেন ব্যস্ততার ভিড়ে সৌন্দর্যের ভাঁজে জমে উঠছে শ্যাওলা। মেদ ঝাড়তে এক বছর নিজেকে ক্যামেরা-অ্যাকশন-কার্ট থেকে ছুটি। ফলটাও দারুণ। ১৭ কেজি ওজন লাপাত্তা। নিজের মধ্যে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে ফেরা। দর্শক ভক্তরা দেখলেন নতুন সৌন্দর্যে মোড়া অন্য এক অপুকে। আরও তাক লাগানো নজর কাড়া এক অপু বিশ্বাস। লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
পুরো নাম অবন্তী বিশ্বাস অপু। বড় পর্দায় অপু বিশ্বাস। নতুন সকাল বরাবরই অপুর পছন্দ। বিন্দু বিন্দু কুয়াশা জমে দুর্বা ঘাসের ডগায়। শিশির ভেজা ঘাসের বুকে পা রেখে এগিয়ে যান আগামীর পথে। আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই। আধো আধো বোল ফুটতেই কথার পিঠে কথা রেখে বাগপটু হওয়ার খেতাব জিতে নেন নিকটজনের কাছ থেকে। যুক্তির আভা চিকচিক করত তার কথায়। সবাই বলত 'এই মেয়ে আইন পেশায় ভালো করবে'। নিজেও ভাবেন 'তাই তো'। স্বপ্নকে দুচোখের পাতায় বন্দী করেন। রুপালি জগতের প্রতি প্রাণের টান একবারেই ছিল না বললে ভুল হবে। ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সেরা দশের ঘরে পৌঁছেও যান। গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় মা অসুস্থ হয়ে পড়লে শেষ পর্যন্ত আয়োজন থেকে গুটিয়ে নিতে হয় নিজেকে। অপু নিজেই জানতেন না তার জন্য অন্যরকম সকাল অপেক্ষা করছে।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন নির্মাণ করেন 'কাল সকালে'। প্রথমবারের মতো অপু যুক্ত হন চলচ্চিত্রে। অভিনয় করেন শাবনূরের বান্ধবীর চরিত্রে। তারপর আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা সুভাষ দত্তের 'ও আমার ছেলে' ছবির বিশেষ একটি চরিত্রে কাজ করা। ব্যস ওখানেই দাঁড়ি টানতে চান অপু। ২০০৭ সাল, এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গায়ে কালো কোট আর গাউন চাপিয়ে আদালতের চৌকাঠ মাড়ানোর স্বপ্নকে সজীব করে তোলার সুযোগ নাগালে। আবার স্বপ্নভঙ্গ! প্রখ্যাত নির্মাতা এফ আই মানিক এবার নায়িকা করবেন তাকে। ছবির নাম 'কোটি টাকার কাবিন'। নায়ক ঢালিউড হার্টথ্রব শাকিব খান। আছেন নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুকের মতো ডাকসাইটে অভিনেতারা। বাবার অমত থাকলেও মা সব কিছু ম্যানেজ করেন।
'কোটি টাকার কাবিন' সুপারহিট। অপু চলে এলেন লাইমলাইটে। ফের পড়াশোনায় মনোযোগ নিবিষ্ট। আবার অপুর দরজায় এফ আই মানিকের কড়া নাড়া। এবার 'পিতার আসন', 'চাচ্চু' ও 'দাদীমা' ছবির প্রস্তাব। নায়ক যথারীতি শাকিব খান। 'না' আর করা হলো না। তিনটি ছবিই সুপার হিট। পারমেনেন্ট হয়ে গেলেন রুপালি জগতে। একই সঙ্গে স্কুলের চৌকাঠ ডিঙিয়ে কলেজে। তুমুল জনপ্রিয়তায় উজ্জ্বল সূর্যের নিচে শুধুই নাও ভাসিয়ে চলা।
২০০৬ থেকে ২০১২। নেহাতই শিশু সময় হলেও মধ্যগগনে ঝড়তোলার মতো সফলতা। ছবির সংখ্যা ৫০ এর ঘর ছাড়িয়েছে। অপুর দোরগোড়ায় সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত্রি নির্মাতাদের দীর্ঘ লাইন। কাজের চাপে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাওয়া। টের পেলেন ব্যস্ততার ভিড়ে সৌন্দর্যের ভাঁজে জমে উঠছে শেওলা। মেদ ঝাড়তে প্রায় এক বছর নিজেকে ক্যামেরা অ্যাকশন কার্ট থেকে ছুটি দিলেন। শুধু ডায়েট কন্ট্রোল আর জিম নয়। সব কিছুতেই রুটিন মেপে চলা। ফলটাও দারুণ। ১৭ কেজি ওজন লাপাত্তা। নিজের মধ্যে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে ফেরা। অবাক-বিস্ময়ে দর্শক-ভক্তরা দেখলেন নতুন সৌন্দর্যে মোড়া অন্য এক অপুকে। আরও তাক লাগানো নজর কাড়া অপু। নির্মাতা আর দর্শক তাকে নিয়ে আরও বেশি আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভাসলেন। সবাই বলেন এই কী সেই অপু, আহা কি দারুণ দেখতে...। ২০১৪ পর্যন্ত অপুর ছবির সংখ্যা ৭২ এর ঘর ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শাকিবের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন ষাটটিরও বেশি ছবিতে। এখন কম করে হলেও এক ডজন ছবি তার দিন-রাত দখল করে আছে। বিরামহীন কাজের মধ্যেও দুবেলা জিম, হেলথ এঙ্পার্টের খাদ্য তালিকা মেনে চলেন অপু। সকালে জুস, ফলমূল। দুপুরে জাউ ভাত, সবজি। রাতে আটার রুটি। মাঝেমধ্যে মাছ ও মুরগির মাংস।
তবে হাজির বিরিয়ানির কথা মনে পড়লে জিভে জল আসে। কফিও প্রিয়। সুযোগ পেলে গুলশানের গ্লোরিয়াস কফি শপে ঢু দেন। কফিশপটা বাড়ির কাছে হওয়ায় নিজেই কার ড্রাইভ করে চলে যান। উষ্ণতার স্বাদ নিয়ে ফুরফুরে হন। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবদাস'-এর পার্বতী প্রিয় চরিত্র। এই চরিত্রে কাজের সুযোগ এনে দেন প্রখ্যাত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। মন-প্রাণ দিয়ে পার্বতীকে নিজের মাঝে ধারণ করেন। কাঁদতে গিয়ে গ্লিসারিন ব্যবহার করতে হয়নি। ক্যামেরার সামনে জীবন্ত পার্বতীকে দেখে মুগ্ধ নির্মাতা। চাষী নজরুল ইসলাম অপু নাম ভুলে পার্বতী নামেই ডাকতেন তাকে। এত কিছুর পরও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে অভিনেত্রী হিসেবে চন্দ্রমুখীকে নির্বাচন করায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন অপু। স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট। অপু বলেন শরৎ বাবু নিজেই পার্বতীকে নায়িকা করে গেছেন, চন্দ্রমুখীকে নয়।
শাকিব খানকে জড়িয়ে প্রেম-বিয়ের খবরে মুচকি হাসেন অপু। প্রথম প্রথম এমন খবরে অস্বস্তি লাগত। পরে বুঝলাম জনপ্রিয়তার মাশুল এটি। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় জুটিকে ঘিরে এমন মজার গল্প জমে ওঠে। দারুণভাবে উপভোগ করি। বরং এ নিয়ে অনেক দিন কিছু না শুনলেই মিস করি।
বর্ষাকাল পছন্দ নয়। কাদা-মাটিতে পথঘাট থিকথিক করে। ঘর থেকে বের হওয়া দায়। সাধারণ মানুষের কষ্ট সহ্য হয় না অপুর। বসন্তকাল অবশ্যই প্রিয়। রঙিন ফুল আর পাখির কলতান জুড়িয়ে দেয় মনপ্রাণ। শীতকালও প্রিয়। মনের মতো করে সাজুগুজু করা যায়। গান শুনতে আর বই পড়তে ভালো লাগে খুব। ভালো লাগে ভালোবাসতে, প্রকৃতি আর মানুষকে।