তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা ঘোষণা করতে লেগে গেল ১৩ বছর। কিন্তু তার পর উচ্চ আদালতে সওয়াল করে জামিন জোগাড় করতে দশ মিনিটও লাগল না!
কেন?
বলিউডের একটা বড় অংশ বলছে, হবেই তো। তিনি যে সকলের ‘ভাই’। কান্না ভেজা গলায় হেমা মালিনী বলছেন,‘‘মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।’’ ‘‘সালমান বড় ভাল ছেলে’’, টুইট করেছেন সোনাক্ষী সিনহা। ‘আমরা সকলে পাশে আছি’, গতকাল সালমানের বাড়িতে এসে বুঝিয়ে দিয়েছেন শাহরুখ খান। সঞ্জয় দত্ত জেলে যাওয়ার সময় এ ভাবেই ‘পাশে’ দাঁড়িয়েছিল বলিউড। তবে সালমানের বেলায় যেন পারদটা আরও কয়েক ধাপ চড়া!
তার মতো ‘বড় মাপের হৃদয়’ এখানে খুঁজে পাওয়া ভার, বলছে ভারাক্রান্ত বলিউড। এ বার কী হবে, তার ঘাড়ে যে ইন্ডাস্ট্রির ৩০০ কোটি টাকার বোঝা, চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন সিনেমা জগতের কলাকুশলীরা। আর বলিউডের এই সমবেত দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে তেরো বছরের এক আইনি নাটক। যে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সল্লু মিঞাঁ। কিন্তু নাটকের শেষটা কী হবে ঠিক করে দিয়েছিলেন যিনি, তিনি মারা গিয়েছেন সেই ২০০৭ সালে, আট বছর আগে। তিনি সালামনের দেহরক্ষী রবীন্দ্র পাটিল।
নাটকের শুরু ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। রাত তখন প্রায় দু’টো। জুহুর ‘রেন বার’ থেকে বেশ কয়েক পেগ বাকার্ডি সাদা রাম, আরও কিছু ককটেল আর চিংড়ি ও মুরগির ভাজাভুজি খেয়ে নিজের সাদা ল্যান্ডক্রুজারে উঠলেন সালমান। বসলেন ড্রাইভারের সিটে। সঙ্গে দেহরক্ষী পাটিল। প্রথমে গেলেন জুহুর পাঁচ তারা জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পরে গাড়ি এগোল বান্দ্রার দিকে। তখনও চালকের আসনে সলমন। এই বান্দ্রাতেই সমুদ্রের সামনে সালমানের ফ্ল্যাট— গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্ট। তার খুব কাছে আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারি। বেসামাল চালক হঠাৎ গাড়ি তুলে দিলেন বেকারির সামনের ফুটপাথে। সেখানে শুয়ে কয়েকজন ফুটপাতবাসী। নিমেষে তারা সেঁধিয়ে গেলেন ‘ভাই’-এর এসইউভি-র তলায়। চাপা পড়ে মারা গেলেন একজন। আহত চার। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা বেশ গুরুতর।
পাটিল ছিলেন সেই ঘটনার প্রথম ও প্রধান সাক্ষী। ঘটনার কিছু দিন আগেই সালমান খান পুলিশের কাছে নিরাপত্তা দাবি করে জানিয়েছিলেন, তাঁার প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। তখন পাটিলকে সালমানের দেহরক্ষী নিয়োগ করা হয়। সেই রাতেই পাটিল থানায় গিয়ে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তিনি সে দিন সালমানকে মদ্যপান না করতে অনুরোধ করেছিলেন। কারণ তিনি নিজে গাড়ি চালাতে পারেন না। গাড়ি সালমানকেই চালাতে হবে। সালমান তার কথায় কান দেননি। সালমানকে গ্রেফতার করা হলেও সে দিনই তাকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। ন’দিন পরে অবশ্য আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন সালমান। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মুম্বাই পুলিশ। ১৭ দিন পরে পাকাপাকিভাবে জামিন পান সালমান।
চলতে থাকে মামলা। ২০০৬ সালে যখন প্রত্যক্ষদর্শীদের জেরা করা হচ্ছে, তখন আচমকা উধাও হয়ে যান পাটিল। তার পরিবার নিখোঁজ মামলা দায়ের করে। আদালতে পাঁচ দিন হাজিরা না দেওয়ার পরে বিচারক নির্দেশ দেন, পাটিলকে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করতে হবে। ২০০৬-এর মার্চে মহাবালেশ্বর থেকে পাটিলকে গ্রেফতার করে ক্রাইম ব্রাঞ্চ। কিন্তু ঘটনার পরে যে পাটিল প্রথম পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন, সেই তিনিই হঠাৎ কেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ে ‘গা ঢাকা’ দিলেন, সে প্রশ্ন তুললেন না প্রশাসনের কেউই। হাই প্রোফাইল মামলায় অনেক সময়েই সাক্ষীদের যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়, তাও দেওয়া হয়নি পাটিলকে। কিছু সাংবাদিক দাবি করেছিলেন, বয়ান পাল্টানোর জন্য পাটিলের ওপর ভয়ঙ্কর চাপ দিত সলমনের পরিবার। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কেউ প্রমাণ দিতে পারেননি।
গ্রেফতারের পরে দাগী অপরাধীদের সঙ্গে পাটিলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর্থার রোড জেলে। কয়েক মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পাটিল দেখেন, তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার পরিবারও তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করে। আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যান পাটিল। ২০০৭ সালে সেওরি মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। খারাপ ধরনের যক্ষায় আক্রান্ত। সে বছরই ৪ অক্টোবর মারা যান তিনি।
পাটিলের মৃত্যুর পরে উপযুক্ত সাক্ষ্যের অভাবে ধামাচাপা পড়ে যায় সালমান মামলা। ২০১১-এ সলমনের বিরুদ্ধে আরও কঠিন ধারা প্রয়োগের আর্জি জানান সরকারি আইনজীবী। সেই শুরু। একের পর এক মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা দাবি। যেমন, চূড়ান্ত সাজা ঘোষণার মাসখানেক আগে সালমানের গাড়ির চালক অশোক সিংহ আচমকা দাবি করে বসেন সে রাতে সালমান নন, তিনিই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। (মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অশোককে তিরস্কার করেছে আদালত।) সালমানও আদালতে বলেন, সেই রাতে বারে বসে আদপেই মদ খাননি তিনি। সালমানের আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, ‘‘যে সাদা রংয়ের পানীয়টি সালমান খাচ্ছিলেন, সেটা আদপেই বাকার্ডি রাম নয়। শুধুই জল।’’ আইনজীবী বলতে থাকেন, সালমান নার্ভের অসুখে ভুগছেন। তিনি যে কত সাধারণ-দরদি, তার ভূরিভূরি তথ্য-প্রমাণ পেশ করা হয়। কাল রাতেও সালমান টুইট করেন, ‘‘যো কাম নহি কিয়া হ্যায়, উসকা ক্রেডিট লেনা সহি হ্যায়? (যে কাজটা আমি করিনি, তার জন্য কি কৃতিত্ব নেওয়া উচিত?)’’
কিন্তু আজ মুম্বাই নগর দায়রা আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত হন সালমান। পৌনে বারোটায় এই রায় দিয়ে বিচারক জানান, ১টা দশে সাজা ঘোষণা হবে। সরকারি আইনজীবী আরও এক বার দাবি করেন, সালমানকে সর্বোচ্চ সাজা, অর্থাৎ ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হোক। সালমানের আইনজীবীরা নানা কারণ দেখিয়ে বলতে থাকেন, সাজা তিন বছরের বেশি যেন না হয়। ১-১০এ বিচারক ঘোষণা করেন, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো সালমানকে। তাকে আর্থার রোড জেলে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে জেলে যেতে হয়নি।
সালমানের আইনজীবীরা তৎক্ষণাৎ ছোটেন বোম্বে হাইকোর্টে। অন্তর্বর্তী জামিনের আপিল করা হয়। দশ মিনিটের শুনানির পরেই জামিন মঞ্জুর হয়। বিচারপতি বলেন, যেহেতু গোটা বিচারপর্বেই সালমান জামিনে ছিলেন এবং নিম্ন আদালতের রায়ের কপি এখনও হাতে পাননি, তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আরও সময় দরকার। বিচারপতি বলেন, সালমানের আইনজীবীর সওয়াল শুনে তার মনে হয়েছে যে ৮ তারিখের মধ্যেই সালমান রায়ের কপি পাবেন। তাই ওই দিন পর্যন্ত তার জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবে এ জন্য সলমনকে নিম্ন আদালতে নতুন করে বন্ড দাখিল করতে হবে।
বোম্বে হাইকোর্টে যখন শুনানি চলছে, তখন দায়রা আদালতেই বসে সালমান। পাঁচটা নাগাদ স্বস্তির খবর আসার পরে জামিনের কাজ মিটিয়ে যখন আদালত থেকে বেরোলেন, ঘড়িতে তখন রাত ৭টা ২৫। রাত সওয়া আটটায় সালমানের গাড়ি ফের ঢুকল গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টে।
আট বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে সালমান বলেছিলেন, ‘‘ক্যামেরার সামনে কান্নাকাটি করার লোক নই আমি। যদি জেলে যেতেই হয়, মুখে তার ছাপ পড়বে না।’’ আজ ক্যামেরার সামনে কাঁদেননি বটে, কিন্তু বিচারক ডি ডব্লিউ দেশপাণ্ডে যখন বলছেন, ‘‘গাড়ি আপনিই চালাচ্ছিলেন। আপনি দোষী’’, তখন চোখে জল চলে আসে ভিলেন-ঠ্যাঙানো নায়কের। সাদা শার্টের হাতায় চোখ মুছে নেন তিনি।
২০০২ সালের সেই রাতে ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দেওয়ার সময়েও ভেঙে পড়েছিলেন সালমান। শুধু বন্ধু ও প্রতিবেশী ফ্রান্সিস ফার্নান্ডেজকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘আমায় বাঁচাও ভাই।’’
আজও জেলযাত্রা থেকে বাঁচলেন চুলবুল পাণ্ডে। অন্তত দু’দিনের জন্য।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
বিডি-প্রতিদিন/ ০৭ মে, ২০১৫/ রশিদা