টিভি অনুষ্ঠান এখন আর কেউ দেখে না। মানহীন অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। সঙ্গে দম বন্ধ করে দেওয়া বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা। অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে মানহীন অনুষ্ঠান দেখতে দর্শক আর চাচ্ছে না। কিন্তু এ কথা কি সব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? উত্তর অবশ্যই 'না'। কারণ 'ইত্যাদি' নামক একটি অনুষ্ঠান এখনো জীবিত আছে। প্রতি বছরের ঈদে অনুষ্ঠানটি জমকালো আয়োজনে প্রচার হয়। এবারও হয়েছে। নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন সবাই। কারণ এই একটি অনুষ্ঠানই আমাদের ঈদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। আর এ জন্যই অনুষ্ঠানের কর্ণধার হানিফ সংকেত বিশাল ধন্যবাদের দাবিদার।
'ইত্যাদি' মানেই সচেতনতামূলক আয়োজনের ভিতরে বিনোদনের সব রকম উপকরণ। এবারও তাই ছিল। এক কথায় মনোমুঙ্কর 'ইত্যাদি' প্রচার হয়েছে।
এবারের ঈদ 'ইত্যাদি'র প্রতিটি পর্বই ছিল প্রশংসিত। প্রতি ঈদেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর গান 'ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে...' দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবার দেখা গেছে শতাধিক কাওয়ালী শিল্পীকে দিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে এ গানটি। তাই গানটি শুনতে অন্যরকম লেগেছে। এবারের ঈদের ইত্যাদিতে শহীদুজ্জামান সেলিম, রোজী সিদ্দিকী ও নাট্যজন আতাউর রহমানের পরিবেশিত মিউজিক্যাল ড্রামায় চমৎকারভাবে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। স্ত্রী বলেন তিনিই সংসারের সব কাজ করেন। স্বামী বলেন তিনিই করেন, স্ত্রীর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। আতাউর রহমান সেলিম-রোজী দম্পতির এ কলহ দেখে বললেন, 'কিসের কথাকাটাকাটি, এই হলো সংসার, ঘরে বাইরে যে যার কাজের, সমান দাবিদার।' এটি চমৎকার একটি বক্তব্য। এখান থেকে দম্পতিদের অনেক কিছু শেখার ছিল।
এদিকে এখন চ্যানেলে চ্যানেলে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব রান্না শেখার ব্যাপারে কারও আগ্রহ নেই বলেই সব রান্নার অনুষ্ঠান প্রচারের যৌক্তিকতা নিয়ে যথার্থভাবেই রান্নাবিষয়ক নাট্যাংশ 'পাকশালা' করা হয়েছে। যেসব শিল্পী এসব অনুষ্ঠানে গিয়ে গান করেন, তাদের প্রতিও ছিল যথার্থ কটাক্ষপাত।
অভিনেতা জাহিদ হাসানকে প্রতীকী চেকের সঙ্গে আমন্ত্রিত দর্শকদের নিয়ে অভিনয় অংশটুকু ছিল উপভোগ্য। 'সাত ভাই চম্পা' গানটির পরিবেশন ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া নারীদের সম্ভ্রমহানির বিরুদ্ধে এটি ছিল একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। ডিজিটাল মুদ্রাদোষ, ফেসবুকের মাধ্যমে পাওনাদারকে খুঁজে পাওয়া, মিছিলের ব্যবসা, ফেসবুকের মাধ্যমে আত্মপ্রচার নিয়ে মামা-ভাগ্নের আলাপচারিতা, নানী-নাতির বিশেষ সার্ভিস নিয়ে মিষ্টি ঝগড়া ছিল বেশ মজার। প্রতিটি পর্বেই ছিল চমৎকার কিছু বক্তব্য। আমাদের কিছু প্রচলিত নীতিকথা নিয়ে দলীয় সংগীতের মাধ্যমে চমৎকার কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এবারের ইত্যাদিতে। দেশের জনপ্রিয় তারকাদের অভিনীত নাটিকার মাধ্যমে ফেসবুকে হিন্দি সিরিয়াল ও কিছু মেয়ের বেপরোয়া চালচলনের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত সার্থকভাবে। বরাবরের মতোই অসাধারণ হয়েছে বিদেশিদের পর্ব। বিদেশিদের মাধ্যমে আমাদের গ্রামীণ জীবনের কিছু টুকরো চিত্রের অসাধারণ চিত্রায়ণ মুগ্ধ করেছে সবাইকে। একটি ছাগলের অন্যের ক্ষেতে ফসল খাওয়া এবং এর ফলে দুই গ্রামের মারামারি এবং গ্রামের মাস্টারের উক্তি- 'ওই মিঞা ছাগল কি বুঝে খেয়েছে, সে তো অবুঝ। কিন্তু তোমরা বুঝের মানুষ হয়েও কেন অবুঝের মতো কাজ কর? তোমরা তো ছাগলের চেয়েও খারাপ।' এর চেয়ে শিক্ষামূলক বক্তব্য আর কি হতে পারে? তারপর দুই পক্ষই একত্রিত হয়ে চমৎকারভাবে বাঙালি ঢঙে শাড়ি পরে নেচে নেচে গাইছে- 'আজ ফুলের মতোন ফুটুক সবার মন, মালার মতোন মানুষে মানুষে গাঁথা হোক বন্ধন।' তখন অন্যরকম এক অনুভূতিতে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এবারের ঈদ 'ইত্যাদি' শেষ হয়েছে অসাধারণ দৃশ্যায়নে অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া চমৎকার বক্তব্যের একটি গান দিয়ে, যা প্রবাসীদের নিয়ে করা। এ গানটি দেখে অনুষ্ঠান শেষে প্রবাসী এবং তাদের আত্মীয়স্বজন আবেগে যদি বাকরুদ্ধ হয়ে থাকেন, তবে বলার কিছু থাকে না। কারণ গানটি বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার মতোই।
সবশেষে অনুষ্ঠানের কর্ণধার হানিফ সংকেতকে ধন্যবাদ। তিনি মানহীন অনুষ্ঠানের ভিড়ে এখনো ভালো মানের 'ইত্যাদি' প্রচার করে যাচ্ছেন। আপনার অক্লান্ত পরিশ্রম চলমান থাক অনন্তকাল।