সম্প্রতি আবারও ঢাকা ঘুরে গেলেন উপমহাদেশের আধুনিক বাংলা গানের সম্রাজ্ঞী হৈমন্তী শুক্লা। ঈদে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে গান পরিবেশন করতে এসেছিলেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, মারাঠিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় গান পরিবেশন করেন এই শিল্পী। এবার বাংলাদেশ ভ্রমণ এবং সংগীত জীবনের নানা বিষয় নিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের। ইন্টারভিউ নিয়েছেন- আলী আফতাব
প্রায় এক বছর পর আবারও বাংলাদেশে এলেন। কেমন লাগছে?
এই বাংলাকে আমার আপন ভুবন মনে হয়। এর আগেও অনেকবার গান পরিবেশন করতে এসেছিলাম, এবারও এলাম। গান করার সময় আমাকে অনেকে ফোন করেছেন। আমার বেশ কিছু কাছের মানুষের সঙ্গে অনেক দিন পর কথা হয়েছে। সব মিলিয়ে অনুভূতি খুব সুখকর।
প্রথম কবে এসেছিলেন বাংলাদেশে?
যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে আমি প্রথম বাংলাদেশে আসি একটি ফিল্মে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য। ওই সময় আমি বাংলাদেশটাকে ঘুরে দেখেছিলাম। তখন থেকে এই দেশটার প্রতি আমার আলাদা একটা মায়া পড়ে যায়। তাছাড়া আমরা সংস্কৃতি-ভাষায় এক। আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলোও একই। তাই বাংলাদেশের মানুষকে এবং বাংলাদেশকে ভিন্ন দেশ মনে হয়নি।
আমরা যতদূর জানি, আপনার বাবার হাতেই আপনার গানের হাতেখড়ি।
হ্যাঁ, আমার বাবা শ্রী হরিহর শুক্লা, মা শ্রীমতি সমত্ত শুক্লা- দুজনই শিল্পী ছিলেন। আর বাবার হাতেই আমার গানের হাতেখড়ি হয়। তারপর আমি উচ্চাঙ্গ সংগীত তালিম নিয়েছি দীর্ঘদিন। এ ছাড়া শাস্ত্রীয় সংগীত ও আধুনিক বাংলা গানের চর্চাও ছিল পাশাপাশি। আমি আমার নিজের জায়গা থেকে সব সময় চেষ্টা করেছি ভালো গান করার। আমার এখনো মনে হয় না আমি বাবার মতো করে গান গাইতে পারি। এতটা পথ পেরিয়ে এসেও এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি ভালো গান করার।
এই সময়ে এসে নিজের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির জায়গাটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমি মনে করি একজন শিল্পীর প্রত্যাশা শুধু একটাই হওয়া উচিত, তা হলো ভালো গাইতে চেষ্টা করা। তখন দেখা যাবে প্রাপ্তি নিজ থেকেই ধরা দেবে। আমি চেষ্টা করেছি বাংলা, হিন্দি, মারাঠিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় গান পরিবেশন করতে। আমি তাতে সফল হয়েছি কি-না জানি না। তবে চেষ্টা তো করেছি। আসলে চেষ্টাটাই আসল। দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠান করে বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছি। পৃথিবীর প্রায় দেশে গান গেয়েছি। বিদেশে এখন পর্যন্ত ২০০ বারের বেশি পারফর্ম করেছি। মাত্র তিন বছর বয়সে আমি গানের প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছি। কীভাবে প্রথম হয়েছিলাম জানি না। এখন পর্যন্ত আমার প্রায় ৬০০ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এসব কিছুই হচ্ছে আমার আত্দতৃপ্তি, প্রাপ্তি কি-না জানি না।
ভক্তদের ভালোবাসার জায়গাটা যদি একটু বলতেন।
৪৫ বছরের সংগীত জীবনে অনেক মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। যেমন বছর কয়েক আগের কথা। বাংলাদেশেরই নারায়ণগঞ্জ। আমি গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। সামনে প্রচণ্ড জ্যাম। একদল মানুষ ব্যান্ডপার্টির মতো ঢোল-বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলছে। আমি কান তাক করে তাদের সুর শুনছিলাম। একটা সময় আমি বুঝতে পারি তারা আমারই একটি গানের সুর বাজাচ্ছে। এছাড়া, একবার সিডনিতে গান করতে গিয়েছিলাম। নিজের রুমে বসে আছি। হঠাৎ প্রচণ্ড দরজা ধাক্কানোর শব্দ। বাইরে এক বৃদ্ধার চিৎকার। তারপর শুনি গার্ডগুলো কাকে যেন ধমক দিচ্ছে। দেখলাম একজন অন্ধ বৃদ্ধ মহিলা ভেতরে আসতে চান। আমি গার্ডগুলোকে বললাম, 'ওনাকে আসতে দাও।' শুধু 'উনি' এলেন না, সঙ্গে ছেলে-বৌমা-নাতি-নাতনি। তারা আমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চান। মহিলা দেখতে পান না কিন্তু আমার পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছবির আবেদন তার কাছে কত বিশাল! সেই দিন আমি তা বুঝেছিলাম। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে যা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না।
কিন্তু এখন অনেক শিল্পীই অল্প কিছু দিন গানের ভুবনে এসে 'সেলিব্রিটি' ইমেজ নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
একদিনের ঘটনা বলি শোন। তখন সবেমাত্র নামডাক হয়েছে আমার। বিভিন্ন জায়গা থেকে গান গাইতে যাওয়ার ডাক আসছে। একবার এক শো পড়েছে প্রত্যন্ত এলাকায়। থাকার জায়গা, বসার জায়গা, খাবার, পানি- কিছুই ঠিক নেই। আমাদের বসতে দেওয়া হয়েছে ভাঙা একটি স্কুলঘরে। দরজা ঠেলে স্কুলঘরের রুমটায় ঢুকতে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। আমি দেখলাম মান্না দে ছাত্রদের বসার একটি ভাঙা বেঞ্চে বসে আছেন। এক কোণে বসে তিনি মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছেন। তার মতো মহান একজন শিল্পী! কত সাধারণ! এসব মানুষকে দেখেই তো আমরা বড় হয়েছি। শিখেছি অনেক কিছু।
এখনো কোন শিল্পীর গান আপনাকে প্রভাবিত করে?
আমি সব শিল্পীর গান শুনি। তবে মান্না দের গান আমাকে অনেক প্রভাবিত করে। আমার গানে মান্না দের ছায়া আছে।
বর্তমান সময়ের গান নিয়ে কিছু বলুন।
বর্তমানে বেশ কিছু ভালো শিল্পী এসেছে আমাদের গানের ভুবনে। কিন্তু এখনকার সংগীতে কণ্ঠের চেয়ে যন্ত্রের কারুকার্য বেশি। আমাদের সময় কণ্ঠের প্রাধান্য ছিল। এটা জেনারেশন গ্যাপের কারণেও হতে পারে।
নিজের পছন্দের গানগুলো নিয়ে কিছু বলুন।
একজন মা'র কাছে তার সব সন্তানই প্রিয়। তবে আমার বেশ কিছু গান এখনো মানুষের মুখে শুনতে পাই। তার মধ্যে রয়েছে 'আমার বলার কিছু ছিল না', 'কাল সারা রাত ছিল স্বপ্নেরও রাত', 'ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না' ইত্যাদি।
শেষ পরিকল্পনা কী?
গানের ভুবনে অনেকটা পথ পেরিয়েছি। বাকিটা জীবন শ্রোতাদের হৃদয়ের গভীরে থাকতে চাই গান নিয়েই।