সৈয়দ হাসান ইমাম
ভারতীয় সিরিয়ালের দাপট কিংবা আগ্রাসন- এ কথাটিতে আমার আপত্তি আছে। কারণ তারা আমাদেরকে জোর করে এসব সিরিয়াল দেখাচ্ছে না। গুলিয়েও খাওয়াচ্ছে না। আমরা স্বেচ্ছায় গোঘ্রাসে গিলছি এসব সিরিয়াল। এর পেছনেও কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান দুটি কারণের একটি হলো- অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনা। যার কারণে আমরা একটি নাটক দেখতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে হাঁপিয়ে উঠি। আমার মনে হয় টিভি চ্যানেলের প্রধানরা এ বিষয়টির ওপর নজর দিলে আমরা অনেকাংশে ভারতীয় সিরিয়াল থেকে দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে পারব। অন্যদিকে আমাদের দেশের বেশির ভাগ সিরিয়াল সপ্তাহে এক কিংবা তিন দিন প্রচার হয়। এর প্রচার সংখ্যা আমাদের আরও বাড়াতে হবে। এর ফলে দর্শকরা নাটকের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবে এবং দেশীয় সিরিয়ালের প্রতি মনোযোগী হবে। আর সবকিছুই করতে হবে মান বজায় রেখে। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ভারত একটি বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি। তাদের বিরুদ্ধে কৌশলে এগোতে হবে।
কাজী হায়াৎ
বর্তমানে আমাদের দেশে যেসব টিভি অনুষ্ঠান হচ্ছে তার বেশির ভাগেরই মানের অভাব। টিভি চ্যানেল বেড়ে যাওয়াও মান হ্রাসের অন্যতম কারণ। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতে সব দিক দিয়ে গ্লামারের আধিক্য। যা আমাদের সিরিয়ালে নেই। মানুষ হচ্ছে সৌন্দর্যপিপাসু। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ভারতীয় অনুষ্ঠানে এই সৌন্দর্য বা গ্লামার পাচ্ছে বলে সহজেই তারা সেই অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের রেমিডি হচ্ছে অনুষ্ঠানের মান উন্নয়ন করতে হবে। গ্লামার বাড়াতে হবে। শিল্পীদের সত্যিকারের স্টার হতে হবে। টেকনিক্যাল ক্ষেত্রেও আমরা দুর্বল, দুঃখের কথা আমাদের কাছে কালার কারেকশন প্যানেল পর্যন্ত নেই। এঙ্পার্ট আছে। মেধা আছে। কিন্তু প্রযুক্তির অভাব। এসব অভাব পূরণ করতে না পারলে নিজেদের অনুষ্ঠানের প্রতি দর্শক আকর্ষণ কখনো বাড়ানো যাবে না। ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতি দর্শক আকর্ষণ কমাতে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিয়ে সব ক্ষেত্রে সমপর্যায়ে যেতে হবে। অনুষ্ঠানের মানের প্রতি নজর দিতে হবে।
হানিফ সংকেত
আমি মনে করি ভালো মানের অনুষ্ঠান এবং চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা কমিয়ে সুষ্ঠু প্রচার পরিকল্পনা করলে এবং ভালো মানের অনুষ্ঠান নির্মাণে বাজেট প্রদানে উদারনীতি গ্রহণ করলে অবশ্যই দর্শকরা ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। ভারতীয় সিরিয়ালে খুব ভালো বিষয়বস্তু থাকে না। মূলত হিংসা, কূটনামী, পরকীয়া, ব্যভিচার, পারিবারিক অশান্তিকে ভিত্তি করে এসব নাটক নির্মিত হয়। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য, মৌলিকত্ব বিসর্জন দিয়ে এসব অনুষ্ঠানপ্রীতি আঘাত হানছে আমাদের অস্তিত্বে। অন্যদিকে এসব চ্যানেলে প্রচারিত পণ্য কেনা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ডিভোর্স, এমনকি আত্দহত্যার ঘটনাও ঘটছে। আমরা জানি রোগ সংক্রমিত হয়, সুস্থতা সংক্রমিত হয় না। ভারতীয় চ্যানেল থেকে প্রচারিত এসব সিরিয়ালও সংক্রামক রোগ, বলা যায় তা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের ঘরে ঘরে। এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে 'ইত্যাদি'তে আমরা বহুবার বলেছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। দ্রুত এর প্রতিকার দরকার।
এ জে এম শফিউল আলম ভূঞা
দিন দিন আমাদের টিভি অনুষ্ঠান থেকে মুখ সরিয়ে হিন্দি সিরিয়ালে দর্শকের ডুবে যাওয়ার মূল কারণ বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা। আগে মানুষ নাটকের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখত। আর এখন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখে। বিষয়টি খুবই হতাশার। পাশাপাশি আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিল্পীর অভিনয়ের গুণগত মান কম। ভারতীয় সিরিয়ালের শিল্পীদের অভিনয় ভালো। এ ছাড়া ভারতীয় সিরিয়ালের নির্মাতারা জানেন, কীভাবে দর্শক ধরে রাখতে হয়। সব মিলিয়ে দর্শক এখন সেই মুখী। আমরা এর থেকে ঘুরে দাঁড়াব, যদি দ্রুত সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে দূর করতে পারি।
ভারতীয় সিরিয়াল আমাদের সমাজে কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে- এ নিয়ে অনেকেই বলেন। কিন্তু বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। গবেষণা না করে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি বিষয়টি নিয়ে গবেষণার জন্য মনঃস্থির করেছি। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে তবে সমস্যা সমাধান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে।
শহীদুজ্জামান সেলিম
এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের সরকারের একটি সঠিক নীতিমালা দরকার। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের দেশে যে পরিমাণ প্রচার হচ্ছে ঠিক সমপরিমাণে আমাদের দেশের নাটক ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার করতে হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এ রূপ ভিন্ন। এর থেকে পরিত্রাণের কয়েকটি উপায় আছে। তার মধ্যে রয়েছে- টিভি বিজ্ঞাপন নীতিমালা। আমরা যদি বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমিয়ে, বিজ্ঞাপনের দাম বৃদ্ধি করে টিভি বিজ্ঞাপনের কিছু চাপ কমাতে পারি। আমাদের ভালো সিরিয়াল নির্মাণ করা দরকার এবং এতে গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের সুযোগ করে দিতে হবে। কয়েক বছর ধরে ঈদের নাটকগুলো দেখে আমরা হতাশ হচ্ছি। অন্যদিকে আমাদের নাট্যজগতে অনেক নির্মাতার প্রবেশ ঘটেছে। এটি আমাদের জন্য শুভ সংবাদ। কিন্তু অনেক সময় তাদের কাজের মান দেখে আমরা হতাশ হচ্ছি। এ জায়গাগুলোতে আমাদের আরও গুণী পরিচালকদের ব্যবহার করতে হবে।