৩১ মে, ২০২৩ ২২:০৬

বগুড়ায় ৫৬৭ বছরের কেল্লাপোশী মেলায় হরেক রকমের মাছ

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

বগুড়ায় ৫৬৭ বছরের কেল্লাপোশী মেলায় হরেক রকমের মাছ

ছবি- বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বগুড়ার শেরপুরে ৫৬৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলায় এবার হরেক রকমের মাছ তোলা হয়েছিল। তিনটি উপজেলা মিলিয়ে অনুষ্ঠিত এই মেলায় সবচেয়ে বড় মাছটি ছিলো ১৪ কেজি ওজনের কাতলা মাছ। এছাড়া ছিলো ১০ কেজি ওজনের মিষ্টি। শতশত বছরের এই মেলায় নিয়ম অনুযায়ি জামাই ও মেয়েকে দাওয়াত করে খাওয়াতে ধুম পড়ে যায়।

গত রবিবার থেকে শুরু হয়ে বুধবার (৩১ মে) সন্ধ্যায় মেলাটি শেষ হয়। মেলায় বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, বিশাল আকারের মাছ, রকমারি মিষ্টি, ঘুড়ি, তৈজসপত্রসহ হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। তবে প্রতিবছরের মতো এবারের মেলায় প্রধান আকর্ষণ মাছ ও মিষ্টি। 

মেলায় দশ থেকে বিশ কেজি ওজনের কাতলা, রুই, বোয়াল, পাঙ্গাস, সিলভার কার্প, চিতলসহ নানা ধরনের মাছ উঠেছিল। সেই সাথে উঠে নানা পদের মিষ্টি। এর কিছু কিছু পদের একেকটি মিষ্টির ওজন পাঁচ থেকে দশ কেজি। মেলা উপলক্ষে শ্বশুর-শাশুড়িরা জামাইদের বাড়িতে দাওয়াত করে বাড়িতে এনে মোটা অঙ্কের টাকা সালামি দেন। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী নিমন্ত্রণে আসা মেয়ে-জামাইদের সঙ্গে নিয়ে এসে ছাতা, মিষ্টি ও লুঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনে দেওয়া হয়। 

বুধবার (৩১ মে) শেরপুর উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কেল্লাপোশী নামক স্থানে অনুষ্ঠিত মেলার শেষদিনে আসা জামাই, শ্যালক-শ্যালিকা এবং মাছ ও মিষ্টি  দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে এইসব তথ্য জানা যায়। মেলাটি শেরপুর উপজেলার মধ্যে হলেও এই মেলার সঙ্গে আদিকাল থেকেই পাশের দুই উপজেলা নন্দীগ্রাম ও শাজাহানপুর উপজেলার বাসিন্দারাও মেলা করে থাকে। 

মাছ ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান জানান, তাদের দোকানের যমুনা নদীর বড় বোয়াল মাছটির ওজন প্রায় দশ কজি। ক্রেতারা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বলেছেন। আর কাতল মাছটির ওজন ১৫ কেজি। দাম হাঁকা হয়েছে আঠারো হাজার টাকা। ক্রেতারা ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বলেছেন। 

মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, পাঁচ থেকে ১০ কেজি ওজনের মাছের চাহিদা বেশি। তাই এই বছর  মেলায় ব্যাপারি এই ওজনের মাছের বেশি এনেছেন। এই ওজনের প্রতি কেজি কাতল মাছ ৫০০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।  

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক থেকে আসা মিষ্টি দোকানি আবু আলম ও গোলাম রব্বানী জানান, তারা ছোট বেলা থেকে এই মেলায় মিষ্টি বিক্রি করেন। তাদের দোকানে পাঁচ থেকে দশ কেজি ওজনের মিষ্টিসহ নানা ধরনের বাহারি মিষ্টি রয়েছে। এইসব মিষ্টি ৬০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

জানা যায়, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই মেলা হয়ে আসছে। বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরশজাত পুত্র এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরশজাত পুত্রের নাম গাজী মিয়া ও দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্যাসীর বেশ ধারন করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মন নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মন রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে তারা দুইজন দুইজনকে ভালবেসে ফেলেন। 

পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকির বেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুন আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোষী নামক স্থানে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সাথে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর ওই দিনটি ছিল জ্যেষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার। 

ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোষী দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপি আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। ওই দিনগুলোকে অম্লান করে রাখতে প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপি মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষে এলাকাবাসি নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এছাড়া নিকট আত্মীয়স্বজনের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা এলাকা। 

এদিকে মেলা শুরু প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা (লাঠি খেলা)। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে এবং সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক ঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা শেষ করে। এবছরও মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্নস্থানে মাদার খেলা চলে।


বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর