শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সচল ঢাকা এখন অচল

যানজট নিরসনে সব উদ্যোগই ব্যর্থ

প্রায় দেড় কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকায় যানজট নিরসনে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। গণপরিবহনের চাহিদা বাড়লেও রাস্তায় বাড়ছে না মান সম্পন্ন যানবাহন। বাড়ছে না রাজধানীর সড়কপথ। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বৃদ্ধি, সংস্কার উপেক্ষিত সড়ক, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা, ফুটপাত পথচারীবান্ধব না হওয়া, ভিআইপি মুভমেন্ট বন্ধ না হওয়াসহ একাধিক কারণে যানজটের কবলে নাভিশ্বাস নগরবাসীর। ট্রাফিক সিগন্যাল, কাউন্ট ডাউন ব্যবস্থা, ফ্লাইওভার নির্মাণ কোনোটিই রাখতে পারছে না যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা।
জানা গেছে, গণপরিবহনের অপর্যাপ্ততা ও ব্যক্তিগত গাড়ির অবাধ বৃদ্ধিই রাজধানীতে যানজট বাড়িয়ে তুলছে। অন্যদিকে মানুষ ও যানবাহনের তুলনায় বাড়ছে না সড়ক। সূত্রমতে, প্রতিটি নগরীতে গণপরিবহন চলাচলের জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সে চাহিদায় রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। এর মধ্যে গণপরিবহন চলাচলের উপযোগী রাস্তা রয়েছে মাত্র ২.৫ থেকে ৩ শতাংশ।
দেশের সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়ন ও যানজট নিরসনে মার্কিন কোম্পানি লুইস বার্জার ২০০৪ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) তৈরি করে এতে ৭১টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। ২০২৪ সাল নাগাদ চার ধাপে এ উন্নয়ন সম্পন্ন করার পরামর্শ দেয় তারা। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প ছিল গণপরিবহননির্ভর। এগুলো হচ্ছে রেলের উন্নয়ন, নৌপথ ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন এবং ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমের রাস্তা মেরামত। জানা গেছে, প্রকল্পগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ওভারল্যাপিং সমস্যাও যানজটের জন্য দায়ী। এক কোম্পানি পরিকল্পনা করলে এর ডিজাইন দেয় আরেক কোম্পানি। আর বাস্তবায়ন করে তৃতীয় আরেক কোম্পানি। পরিবহন-বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা, ডিজাইন ও বাস্তবায়নের কাজ করলে সমন্বয় সংকট দূর করা যেত। এতে যানজট নিরসনে ও রাস্তার গুণগত মান উন্নয়নে সম্ভব হতো কার্যকর ভূমিকা রাখা। কিন্তু বর্তমানে হচ্ছে না তার কিছুই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ)-এর ক্ষমতা ও লোকবল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এটি স্বল্প মেয়াদে কাজ করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে একে কার্যকর করতে পারলে, ফুটপাতকে পথচারীবান্ধব করে ৭১টি প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে তা যানজট নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। জানা গেছে, সরকার ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজধানীতে যানজট নিরসনে নতুন নতুন ফ্লাইওভার নির্মিত হলেও কমছে না যানজট। গণপরিবহনের কোনো প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফ্লাইওভারগুলোও গণপরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক, পরিবহন-বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) ঢাকায় যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনা। কিন্তু এতে নজর দেওয়া হয়নি। এসটিপির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন গণপরিবহনভিত্তিক বাসগুলোর পরিবহনক্ষমতা নেই বললেই চলে। আগে যে পরিবহনগুলো ১০ ট্রিপ দিতে পারত, সেগুলো এখন দুই ট্রিপও দিতে পারছে না। গণপরিবহন না থাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে ছোট গাড়ির আধিক্য বাড়ছে। এতেও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে যানজট। রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে না। অন্যদিকে রাস্তাজুড়ে অবৈধ পার্কিং, নির্মাণসামগ্রীসহ বিভিন্ন জঞ্জালে বেদখল থাকায় যতটুকু রাস্তা রয়েছে এগুলোও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে রাস্তার যানজট বেড়েই চলেছে। ফলে দুর্বল হয়ে গেছে শহরটির ভিত। সূত্র জানায়, ভিআইপি মুভমেন্টের ফলেও যানজট প্রকট আকার ধারণ করছে। একবার ভিআইপি মুভমেন্ট হলে পুরো ঢাকা এলোমেলো হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে শহরে যানজটের যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ, সেখানে ভিআইপিরা পুরো রাস্তা ফাঁকা করে যান। এটি হওয়া উচিত নয়। জনগণের মতো তারা কষ্ট না পেলে তাদের হুঁশ হবে না। তারা এ সুযোগ অন্যায়ভাবে নিয়ে যাচ্ছেন। এটি জনগণকে কষ্ট দিয়ে তাদের বিলাসিতা। যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সিগন্যাল ব্যবস্থা থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, ‘সরকার সিগন্যাল দিয়ে যানজট কমাতে চাইছে। মোড়ে গাড়ির চাপ বেশি থাকলে সিগন্যাল কাজ করে না। এত কাছাকাছি সিগন্যাল থাকাও ঠিক নয়। এসব না জেনেই কাউন্ট ডাউন সিগন্যাল আনা হয়েছে। আমাদের বোঝারও ঘাটতি রয়েছে।’
যানজটের কারণ জানতে চাইলে এক চালক বলেন, ‘ঢাকার প্রধান সড়কগুলো সমান্তরাল নয়, আঁকাবাঁকা। রাস্তা যতটুকু প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন সমান্তরাল হওয়া। অনেক রাস্তায় পরিবহনগুলো ঢুকতেও পারে না। রাস্তায় এমন বাঁক থাকবে না যাতে গাড়ি আটকে যায়। দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলবে এটিই কার্যকর রাস্তা। আমাদের দরকার একমুখী রাস্তা করা।’ তবে আশার কথা হচ্ছে ইদানীং আবাসিক এলাকাগুলোতে এ রকম রাস্তা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর