শিরোনাম
শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

রেল লাইনের ওপর অর্ধশতাধিক বাজার মাসে ৪০ দুর্ঘটনা

রাজধানীতে রেল লাইনের দুই পাশে যেখানে দেয়াল নেই, সেখানেই গড়ে উঠছে অবৈধ বাজার। এমন অর্ধশতাধিক স্পটে গড়ে ওঠা কাঁচাবাজার বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ক্রেতারা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়েই তাদের বাজার সারছেন। যখন ট্রেন আসে, তখনই বাধে হুলুস্থূল। ক্রেতা-বিক্রেতারা একযোগে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এর মধ্যেই কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর পরও বিপজ্জনক এ বাজারগুলো বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেই। মাঝেমধ্যে অবৈধ এসব বাজার উচ্ছেদে লোক দেখানো অভিযান চলে। সকালে উচ্ছেদ করা হলে বিকালেই ফের বসে বাজার। বিকালে উচ্ছেদ হলে রাতেই তা আবার জমজমাট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ এসব বাজার থেকে মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। রেলওয়ে, থানা পুলিশ এবং রেলওয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে বিপজ্জনক বাজারগুলো। যে কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও অবৈধ স্থাপনা ও বাজার উচ্ছেদে খুব একটা জোরালো পদক্ষেপ নেন না সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ ও রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ৪০টি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটে বাজার ও লেভেল ক্রসিংয়ের সামনে। সর্বশেষ গতকাল সকালে কারওয়ান বাজারে ট্রেনের ধাক্কায় চারজন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন। ট্রেন আসতে থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকেই ছোটাছুটি করে নিরাপদ ভেবে পাশের লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু উল্টো দিক থেকে যখন ওই লাইনেই আরেকটি ট্রেন আসতে থাকে তখনই মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। জানা গেছে, টঙ্গী, উত্তরখান, কসাইবাড়ী, খিলক্ষেত, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী, নাখালপাড়া, তেজকুনিপাড়া, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, মগবাজার, গোপীবাগ, টিটিপাড়া, জুরাইনসহ বেশকিছু এলাকায় গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক বাজার বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এমন কিছু বাজার রয়েছে যেখানে ৫০ গজ দূরে ট্রেন থাকলেও দেখা সম্ভব হয় না। সরেজমিনে জানা যায়, কারওয়ান বাজার রেল লাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাজার যেন একটি মৃত্যুফাঁদ। তেজগাঁও রেল ক্রসিংয়ের পাশেই ট্রাকস্ট্যান্ডের কারণে রেল লাইনের এক পাশ দখল হয়ে আছে। রেল লাইনের ওপর মাছের বাজার আর পাশের জায়গা দখল করে দোকান গড়ে তোলার কারণেই বারবার ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে সেখানে। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত পুরো রেল লাইনের ওপর বিরাট এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা মাছের আড়তে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম থাকে।
রেল লাইনের দুই পাশে দোকান থাকায় ট্রেন আসা-যাওয়ার মুহূর্তে লোকজন নিরাপদ দূরত্বে যেতে পারে না। জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মজিদ জানান, বারবার রেল লাইন ও পাশের জায়গায় বাজার-দোকানের বিষয়ে তাগিদ দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা কোনো কথা শোনেন না। স্থানীয় বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, রেল পুলিশকে মাছবাজারের পক্ষ থেকে বড় সুবিধা দেওয়া হয়, যে কারণে তারা কিছুই বলেন না। খিলগাঁও রেল ক্রসিং হচ্ছে কমলাপুর স্টেশন থেকে প্রতিটি রেলের অভিমুখ এবং আন্তঃমুখ পয়েন্ট। অথচ এ ক্রসিংমুখের চারপাশেই গড়ে উঠেছে ঝুপরি টানিয়ে শাকসবজি ও মাছ-মাংসের বাজার। এমনকি দুই রেলপথের মাঝখানে খাচি, টুপরি, ঝাঁকা পেতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি চলছেই। এ ছাড়া রাতভর এ বাজারে মাছের আড়ৎ বসে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে। গত মাসে এ এলাকা থেকে বাজার উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়। সকালে উচ্ছেদ অভিযান চললেও বিকালেই সেখানে বাজার আবার জমজমাট হয়ে ওঠে। বিমানবন্দর রেল ক্রসিংয়ের ওপরই নিয়মিত বসছে বাজার। ফলমূল, মাছ, সবজিসহ নানা পসরা নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। খিলক্ষেত রেল ক্রসিংয়ের ওপর দিনভর বসে কাঁচাবাজার। ভয়াবহ অবস্থা জুরাইনে। সেখানে রেল লাইনের দুই পাশে কাঁচাবাজার থাকলেও দখলদাররা একেবারে রেল লাইনের স্লিপার পর্যন্ত চলে এসেছেন। ক্রেতারাও রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে বাজার সারছেন। রেল লাইনের দু-তিন ফুট দূরেই বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। যখন ট্রেন আসে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নিরাপদে যায়। মহিলারা থাকলে তাদের জন্য সরে যাওয়া কষ্টকর। আশপাশের দোকানের সঙ্গে মিশে লোকজনকে দাঁড়াতে হয় তাদের।
মগবাজার রেল লাইনের ওপর কাঁচা বাজারে সকাল থেকেই মানুষ ব্যস্ত থাকে কেনাকাটায়। তবে বিপত্তি ঘটে তখনই যখন দ্রুত গতিতে আসা ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে ছুটে যায়। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকটা বাধ্য হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ব্যবসার আয়োজন নিয়ে বসেছেন তারা। ক্রেতারাও স্বীকার করেছেন এ ঝুঁকির কথা, তবে হাতের কাছেই প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়ায় তারা এখানেই কেনাকাটা করেন। রাজধানীর এ অবৈধ বাজারগুলো থেকে মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। রেল পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় থানা পুলিশ, গেটম্যান থেকে শুরু করে এ টাকা রেলভবন পর্যন্ত যায় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। তবে প্রকাশ্যে তা কেউই স্বীকার করেন না। আর যারা এ চাঁদা তোলেন তাদেরও আইনের আওতায় নেয় না রেল পুলিশ। ডিএমপির তেজগাঁও থানার আয় সবচেয়ে বেশি বলে এটিকে দামি থানা বলা হয়। কারওয়ান বাজারের কারণেই এ থানার আয় বেশি বলে জানিয়েছে পুলিশের একাধিক সূত্র।

সর্বশেষ খবর