শনিবার, ২১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কিলিং মিশন এবার কুষ্টিয়ায়

বাউলভক্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক খুন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আহত

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

কিলিং মিশন এবার কুষ্টিয়ায়

নিহত চিকিৎসক সানাউর রহমান। ডানে আহত ইবি শিক্ষক সাইফুজ্জামান —বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার কুষ্টিয়ায় মীর সানাউর রহমান (৫৭) নামে এক হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। একই কায়দায় কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে নিহতের বন্ধু কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুজ্জামানকে (৩৮)। স্থানীয়রা গুরুতর অবস্থায় তাদের দুজনকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা সানাউরকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য গতকালই হেলিকপ্টারে আহত শিক্ষককে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে কুষ্টিয়া শহর থেকে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বটতৈল ইউনিয়নের শিশির মাঠ এলাকায় নৃশংস এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি ডাঁসা ও কাঠের বাটাম উদ্ধার করেছে বলে জানা গেছে। নিহত চিকিৎসক মীর সানাউর লালনভক্ত ছিলেন। তার সঙ্গে বিভিন্ন মাজারে বাউলগান শুনতে যেতেন শিক্ষক সাইফুজ্জামান। মীর সানাউর রহমান শহরের পূর্ব মজমপুর এলাকার মৃত মীর বজলার রহমানের ছেলে। আহত সাইফুজ্জামান হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর বোয়ালদহ এলাকার নূরুজ্জামান বিশ্বাসের ছেলে। পুলিশের ধারণা, দুই বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পীর, ফকির, সুফিবাদীসহ মুক্তমনা ব্যক্তি খুনের মতোই এটি একটি ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে জঙ্গিবাদের হাত থাকতে পারে। গত বছর ১০ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গায় একই কায়দায় খুন হন স্থানীয় বাউল উৎসবের আয়োজক জাকারিয়া সরদার। এ ছাড়া ২০১৪ সালের নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলনকে। তিনিও লালনভক্ত ছিলেন।

পুলিশ, নিহতের পরিবার ও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়া সদরের বটতৈলের শিশিরমাঠ এলাকায় হোমিও চিকিৎসক মীর সানাউর রহমানের একটি বাগানবাড়ি রয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এলাকার মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। অন্য দিনগুলোর মতো গতকাল সকালে মোটরসাইকেলে করে বন্ধু সাইফুজ্জামানকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বাগানবাড়িতে যাচ্ছিলেন সানাউর। তবে বাগানবাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার আগে অপর একটি মোটরসাইকেলে থাকা তিন অজ্ঞাত যুবক সানাউরের মোটরসাইকেলের গতি রোধ করে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সানাউরের ঘাড় ও মাথায় কোপাতে শুরু করে তারা। শিক্ষক সাইফুজ্জামান বাধা দিলে তারও রেহাই মেলেনি। হাত দিয়ে ঠেকাতে গেলে তার আঙুল কেটে মাটিতে পড়ে যায়। দুর্বৃত্তরা সাইফুজ্জামানের ঘাড়ে ও মাথায় নির্মমভাবে কোপায়। নৃশংস এ ঘটনার পর মোটরসাইকেলে করে তিনজনকে দ্রুত পালিয়ে যেতে দেখেন এলাকার লোকজন। পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আহত শিক্ষককে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয় সাবেক মেম্বার জামাল উদ্দিন বলেন, মীর সানাউর রহমান ২০ বছর আগে এলাকায় পাঁচ বিঘা জমি কিনে সেখানে বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। প্রচুর ফলের গাছ রয়েছে তার বাড়িতে। ওই বাড়িতে বসেই তিনি প্রতি শুক্রবার রোগী দেখতেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা রোগী দেখতেন তিনি। ভারত থেকে ওষুধ এনে রোগীদের ফ্রি দিতেন। কোনো টাকা নিতেন না। তিনি জানান, এলাকার রাস্তাটি কাঁচা ছিল। এলাকায় বিদ্যুৎও ছিল না। এই সানাউর রহমানই যোগাযোগ করে রাস্তাটি তৈরি করে দেন। পরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন তিনি। এলাকার নারী, পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তার কোনো শত্রু ছিল বলে তাদের জানা নেই। তাহলে কারা হত্যা করল— এমন প্রশ্নে নির্বাক হয়ে যান ওই মেম্বার। এলাকার আরও কয়েকজন জানান, বাগানবাড়িতে নিয়মিত গানের আসর বসত। সেখানে অনেক লোকজনের মধ্যে আহত শিক্ষকও আসতেন। লালনের গান শুনতেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে লেখক, ব্লগার ও শিক্ষকদের ওপর যে হামলা হয়েছে, এর সঙ্গে এ হামলার অনেকটা মিল রয়েছে। মোটরসাইকেলে এসে তিন যুবক এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। ব্যক্তিগত কোনো ঝামেলা ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হত্যার শিকার চিকিৎসক বাউল অনুসারী। কুষ্টিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহাবুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে হত্যার কারণ জানা যায়নি। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাও এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। পুলিশ ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। আশা করছি শিগগিরই খুনিদের শনাক্ত করতে পারব।’ মীর সানাউরের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মীর আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার ভাই একসময় শহরের বড় ঠিকাদার ছিল। তবে ১০ থেকে ১৫ বছর হলো সে এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর থেকে সে নিরিবিলি জীবনযাপন করত। অবশ্য পরে সে আরেকটি বিয়ে করেছে। তার এক ছেলে বিমানবাহিনীতে চাকরি করত। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় বসবাস করছে। নিজের বাগানবাড়ি ছাড়াও কুষ্টিয়া ক্লাবে সানাউর প্রতি বৃহস্পতিবার ফ্রি রোগী দেখত। এলাকায় তার কোনো শত্রু আছে বলে আমাদের জানা নেই।’

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তাপস কুমার পাল বলেন, নিহতের হাতে, ঘাড়ে ও মাথায় এলোপাতাড়ি আঘাত করা হয়েছে। আঘাতের ধরন দেখে মনে হয়েছে, পেশাদার খুনিরা এ কাজ করেনি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আহতের অবস্থাও গুরুতর। শিক্ষক সাইফুজ্জামানের বাড়ি শহরতলির হরিপুর ইউনিয়নে হলেও তিনি ভাড়া থাকেন শহরের কালিশংকরপুর এলাকায়। সাইফুজ্জামানের স্ত্রী সোনিয়া সুলতানা শিখা জানান, তার স্বামীর সঙ্গে কারও শত্রুতা থাকতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে তাও আঁচ করতে পারছেন না তিনি। গতকাল বিকালে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিহত চিকিৎসক সানাউর রহমানের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ শহরের পূর্ব মজমপুর সাদ্দাম বাজার গলির বাড়িতে নেওয়া হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর