শিরোনাম
শনিবার, ২১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ সারা দেশে সতর্কতা

সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ২১ লাখ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’। পশ্চিম মধ্য-বঙ্গোপসাগর ও তত্সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড়টি সামান্য উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এটি গতকাল সন্ধ্যারাতে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তত্সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ বিকাল অথবা সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী উপকূল অতিক্রম করতে পারে। আজ সকালেই উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং দুপুরের পর আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত, কক্সবাজার উপকূলকে ৬ নম্বর এবং মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক সামছুদ্দিন  আহমেদ বলেন, ঝড়ের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার থাকবে। চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের জেলার উপকূলে ৭ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। মাঝারি ধরনের ঝড় হওয়ায় আমাদের আশা সতর্ক সংকেত ৭-ই থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের আবহাওয়া অধিদফতরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় আজ দুপুর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল উপকূলীয় জেলা-উপজেলাসমূহের সড়ক ও জনপথ বিভাগের সব প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল ঘোষণা করেছেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সওজ কর্মীরা নিজ নিজ স্টেশনে অবস্থান করবেন। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ও সড়কের গাছ অপসারণে প্রস্তুত থাকতে প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় সড়ক বিভাগের সব ফেরি গতকাল সন্ধ্যা থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সকাল থেকেই দেশের উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বইছে স্বাভাবিকের তুলনায় শক্তিশালী ঝড়ো হাওয়া। উপকূলের নিচু এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ঝড়-পরবর্তী উদ্ধার ও ত্রাণ তত্পরতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। প্রতিকূল আবহাওয়ায় সব ধরণের নৌ-চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানান, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। সে সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই ঝড় আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ শনিবার বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ চট্টগ্রাম-বরিশাল অঞ্চলের ওপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা। 

উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। এ ছাড়া কক্সবাজার উপকূলে ৬ নম্বর বিপদ ?সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। এদিকে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৫ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৫ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার-পাঁচ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর জেলা এবং এগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিসহ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার সব নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।

সারা দেশে নৌ-চলাচল বন্ধ : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় সব ধরনের নৌ-চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (ট্রাফিক) মফিজুর রহমান বলেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে গতকাল বিকাল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আরও উত্তর-উত্তর পূর্বে বাংলাদেশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসায় সমুদ্রবন্দরগুলোতে বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর।

সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সাড়ে ২১ লাখ লোক : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ক্ষতি মোকাবিলায় গতকাল রাত ৮টার মধ্যেই উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে সরে যেতে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাত ৮টার মধ্যে তাদের সরিয়ে নিতে সারা দেশে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ১৮ জেলার সাড়ে ২১ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলেও জানান সচিব। শাহ কামাল বলেন, গতকাল দুপুর থেকেই মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া শুরু হয়। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে এমন ১৮টি  জেলার ৩ হাজার ৮৫১টি আশ্রয় কেন্দ্রে এসব মানুষকে আনা হবে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজার উপকূলে সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে এবং সাগর ও উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেছে।

চকরিয়া : চকরিয়ার উপকূলীয় ৮ ইউনিয়ন ও পেকুয়ার ৭ ইউনিয়নের ৩ লক্ষাধিক মানুষ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। গতকাল দুপুরের পর থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে তাত্ক্ষণিক নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

পটুয়াখালী : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র প্রভাবে পটুয়াখালীর উপকূলে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছিল। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলায় মোট ৯টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। দুর্যোগকালীন সময় মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে ৩৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বাগেরহাট : মংলা বন্দরে অবস্থানরত সব জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজ গতকাল থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। মংলা বন্দরে অবস্থানরত সব দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে নিরাপদে সতর্কাবস্থায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌবাহিনীর বিএনএস মংলা নৌঘাঁটির সব যুদ্ধজাহাজসহ কোস্টগার্ডের অন্যান্য নৌযানগুলোকে নিরাপদ স্থানে নোঙর করে রাখা হয়েছে। শরণখোলার ৭৬টিসহ জেলার অপর ৮ উপজেলায় সর্বমোট ২৩৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বরিশাল : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বরিশালে গতকাল দিনভর বৃষ্টিসহ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কখনো ভারি আবার কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলা নদী তীরের কিছু জনবসতিসহ বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।

চরফ্যাশন (ভোলা) : গতকাল  দুপুরের পর থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর বাতাসের গতি বৃদ্ধি পায়। দিনভর আকাশ ছিল গুমোট-মেঘাচ্ছন্ন। ভোলার চরফ্যাশন উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আতঙ্কে নিম্নাঞ্চল এলাকার লোকজনকে দ্রুত সাইক্লোন শেল্টারে সরিয়ে নিতে প্রশাসন তত্পরতা চালিয়েছে।

বরগুনা : ‘রোয়ানু’ এর প্রভাব ও জোয়ারের পানির চাপে বরগুনায় বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল সকালে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামে ৪১/১ পোল্ডারে একটি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যায়। ফলে ওই এলাকার বাড়িঘর, কৃষিজমি ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।

ঝালকাঠি : ঝালকাঠিসহ দক্ষিণাঞ্চলে গতকাল সকাল থেকে কখনো হালকা বাতাস ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। এতে শহরের অধিকাংশ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : বৈরী আবহাওয়ার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে ৬ নৌ-রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্দরে আটকা পড়েছে শতাধিক মালবাহী কার্গো জাহাজ।

নোয়াখালী : উপকূলীয় প্রতিটি জেলায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজনকে আশ্রয়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মাদারীপুর : বিআইডব্লিউটিসির কাওড়াকান্দি ঘাট সূত্রে জানা গেছে, সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের নদ-নদীগুলো কিছুটা অশান্ত। পদ্মায় সকাল থেকেই ঢেউয়ের মাত্রা বাড়ছিল।

সর্বশেষ খবর